পঞ্চানন মল্লিক

  ২৩ জানুয়ারি, ২০১৮

বইমেলা

সংস্কৃতির অংশ

বছর পরিক্রমায় একে একে এগারোটি মাস অতিক্রম করে আবার আমাদের মধ্যে আসছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। জানুয়ারির আর মাত্র কয়েকটা দিন অতিক্রান্ত হলেই আমাদের মধ্যে এসে দাঁড়াবে মহান ঐতিহ্যের আর ভাষার জন্য রক্তদানের মহান ত্যাগে ভাস্মর এই মাস। এ মাসের শুরুর দিন থেকেই প্রতি বছরের মতো উদ্বোধন হবে একুশের বইমেলা। লেখক ও পাঠকের মনের অনুরণন মিশে থাকে যে মেলায় তার নাম বইমেলা। এ মেলায় সমাগম ঘটে লেখক, পাঠক, প্রকাশকসহ অগণিত পাঠকের। সব শ্রেণিপেশা, বয়সের মানুষের পদচারণে মাসব্যাপী মুখরিত হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। স্বাধীন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলোর অন্যতম হচ্ছে এ বইমেলা। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণের বটতলায় এক টুকরো চট বিছিয়ে তার ওপর ৩২টি বই সাজিয়ে গোড়াপত্তন করেছিলেন একুশে বইমেলার। ৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত একাই বইমেলা চালিয়ে যান তিনি। পরে তার দেখাদেখি অন্যরাও অনুপ্রাণিত হন। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে বইমেলার সঙ্গে প্রথম সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ সালে চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি এই মেলার সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমিতে প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজন সম্পন্ন করেন। তবে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয় ১৯৮৪ সালে। এরপর ক্রমেই সম্মুখে এগিয়ে চলা। সেই ৩২টি বইয়ের প্রথম মেলা আজ পরিণত হয়েছে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী প্রাণের মেলায়। প্রতি বছর বইমেলাকে সামনে রেখে লেখকদের প্রাণ যেন জেগে ওঠে।

লেখকরা সারা বছর ধরে লেখা সঞ্চয় করে রাখেন এ মেলায় প্রকাশের জন্য। ফেব্রুয়ারি আসার কয়েক মাস আগে থেকে প্রকাশকের দফতরে আনাগোনা ও যোগাযোগ শুরু হয়। স্ক্রিপ্ট বা পা-ুলিপি মনঃপূত হলে শুরু হয় বইয়ের মুদ্রণ প্রক্রিয়া। এভাবে আলোর মুখ দেখে শত শত বই। জীবনের প্রথম বইটি যেন লেখকের কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয়তর। একজন কৃষক যেমন কষ্ট-ক্লেশে জমি চাষ করেনÑতাতে সোনার ফসল ফললে তৃপ্তিতে আত্মহারা হয়ে যান। একজন লেখকও তেমনি প্রথম বইয়ের দর্শনে, স্পর্শে আবেগাপ্লুত ও আনন্দে আত্মহারা হন। সে অর্থে বই লেখকের সন্তানের মতো। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশ্য এখন বই তুলতে হয় প্রাণের মেলায়। তার পরও লেখকরা পিছপা হন না। ছুটে যান হৃদ্যিক টানে সাহিত্য সুধার সম্মুখ পানে। বইমেলা যেন তাদের সেই প্রত্যাশার দুয়ার খুলে দেয়। নানা শ্রেণির পাঠকও আসেন বইমেলায়। কেনেন সাধ্যমতো পছন্দের বই।

সব ধরনের বইয়ে সাজানো হয় স্টল। কাব্যগ্রন্থ, গল্পগ্রন্থ, ছড়ার বই, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, নিবন্ধ সংকলন, শিশুতোষ বইসহ হরেক রকম বই থাকে স্টলে। দর্শনার্থীরা বেছে বেছে পছন্দমতো সব বই কেনেন যার যার ইচ্ছা ও সাধ্যমতো। প্রতিদিন মেলায় থাকে আলোচনা সভা, স্বরচিত কবিতা ও লেখা পাঠের আসর, সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি। এ ছাড়া মেলায় থাকে লেখককুঞ্জ, যেখানে লেখকরা উপস্থিত থেকে পাঠক ও দর্শকদের সঙ্গে তাদের বই ও লেখার ব্যাপারে মতবিনিময় করেন এবং সবার সঙ্গে পরিচিত হন ও কুশলাদি বিনিময় করেন। নতুন মোড়ক উন্মোচিত বই ও তার লেখকের নাম মেলার তথ্যকেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া প্রকাশিত নতুন বইয়ের তালিকাও লিপিবদ্ধ করা হয়। লেখক-পাঠকরা বইমেলায় অপার আনন্দে মেতে ওঠেন। পরিচয় ঘটে অনেক অজানা, অচেনা লেখকের সঙ্গে। গড়ে ওঠে সেতুবন্ধ, হয় ভাব ও মতের বিনিময়। আজকাল ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগ, জেলা/উপজেলা পর্যায়েও বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। স্থানীয় লেখক, পাঠকদের প্রাণের দাবি এখানে পূরণ হয়। দেশের খ্যাতিমান, চেনাজানা লেখকদের পাশাপাশি অজপাড়াগাঁয়ের অখ্যাত, অপরিচিত লেখকরাও চেষ্টা করেন এ মেলায় এসে সবার সঙ্গে পরিচিত হতে, তাদের লেখনী তুলে ধরতে। মেলা উপলক্ষে কারো কারো বই প্রথম প্রকাশনার মুখ দেখে। হয় মোড়ক উন্মোচন। এভাবে বেরিয়ে আসেন অনেক প্রতিশ্রুতিশীল লেখক। হয় অনেকেরই লেখক হওয়ার স্বপ্নপূরণ। আধুনিক নেট-কেবলের যুগে যদিও হারিয়ে যাচ্ছে সৃজনশীল বইয়ের আবেদন ও পাঠাভ্যাস। তবু বইমেলা যেন এখনো জাগিয়ে রেখেছে সৃজনশীল সাহিত্য আর লেখক-কবিদের মনের সুপ্ত বাসনাকে। তবে এ মেলা থেকে আমাদের প্রত্যাশা কতটা পূরণ হচ্ছে সেটাও বিবেচ্য বিষয়। বইমেলা মানে লেখক-প্রকাশক-পাঠকÑএই তিন শ্রেণির মানুষের মেলা। এই তিন শ্রেণির প্রত্যেকের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন জড়িয়ে রয়েছে এ মেলার সঙ্গে। তাই তাদের প্রত্যাশা বা আকাক্সক্ষা কতটা পূরণ হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে এ মেলার সার্থকতা। একজন লেখক সব সময় চান তার সেরা লেখাটাই মেলায় উপস্থাপন করতে। আর এ ব্যাপারে সহায়ক মাধ্যম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন একজন প্রকাশক। এ ধারা অব্যাহত ছিল আছে এবং থাকবে-এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist