সাবরিনা শুভ্রা
নিবন্ধ
দাসত্বের বেড়াজালে ১৫ লাখ
দাসত্ব বলতে বোঝায় কোনো মানুষকে জোর করে শ্রম দিতে বাধ্য করা এবং এ ক্ষেত্রে কোনো মানুষকে অন্য মানুষের অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। কাউকে তার ইচ্ছার পরিবর্তে দাস করা যেতে পারে। এটি হতে পারে তার আটক, জন্ম, ক্রয় করা সময় থেকে। দাসদের অনুমতি ব্যতিরেকে স্থান বা মালিককে ত্যাগ করা, কাজ না করার বা শ্রমের মজুরি পাওয়ার অধিকার নেই।
দাসত্ববিরোধ আন্তর্জাতিক সংগঠন অ্যান্টি-সø্যাভেরি ইন্টারন্যাশনাল দাসত্বের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে একে ‘জোরপূর্বক শ্রম দেওয়া’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, বর্তমান বিশ্বে এখনো ২ কোটি ৭০ লাখ দাস রয়েছে। এই সংখ্যা ইতিহাসের যেকোনো সময়কার দাসের সংখ্যার তুলনায় বেশি। এমনকি প্রায় ৪০০ বছরের ইতিহাসে আফ্রিকা থেকে আমেরিকায় আনা আফ্রিকান দাসের মোট সংখ্যাও এর প্রায় অর্ধেক।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা জোর করে শ্রম দেওয়াকে দাসত্ব হিসেবে ধরে না। তাদের হিসাব অনুযায়ী এখনো বিশ্বের ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ জোর করে শ্রম, দাসত্ব, ও দাসত্ব সংশ্লিষ্ট প্রথার কাছে বন্দি। এই দাসের বেশির ভাগই ঋণ শোধের জন্য দাসে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী মহাজনদের কাছ থেকে অর্থ ধার নিয়ে পরবর্তী অর্থ শোধ দিতে না পারায় দাসে পরিণত হয়েছে। এদের মধ্যে কিছু আছে যারা কয়েক প্রজন্মের জন্য দাস। মানুষ পরিবহন মূলত হয়ে থাকে নারী ও শিশুদের যৌন ব্যবসায় খাটানোর জন্য। এটিকে বর্ণনা করা হয় ‘ইতিহাসের সর্ববৃহৎ দাস বাণিজ্য’ হিসেবে। অবৈধ মাদকদ্রব্য পরিবহনে ব্যবহার করার কারণে একই সঙ্গে এটি বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অপরাধ ক্ষেত্র। প্রাচীনকালে এবং মধ্যযুগে সমাজে মানুষ কেনাবেচার একটি প্রথা ছিল, যা দ্বারা বিভিন্ন মূল্যের বিনিময়ে মানুষ কেনা যেত। এই প্রচলিত প্রথাটিকেই দাসপ্রথা বলা হয়ে থাকে। দাস অথবা দাসী বর্তমান বাজারের পণ্যের মতোই বিক্রি হতো। বর্তমানে যেমন পণ্য বেচাকেনার বাজার আছে, অতীতেও দাসদাসী বিক্রি অথবা ক্রয়ের জন্য আলাদা বাজার ছিল। তখন দাসদাসী আমদানি এবং রফতানিতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হতো এবং এটা দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়ত। সাধারণত দাসদাসীরা আফ্রিকান হতো। আফ্রিকান দাসের মধ্যে হাবশি ও কাফ্রির চাহিদা ছিল বেশি। বাংলায় এসব দাসদাসী ৫ থেকে ৭ টাকায় কেনা যেত এবং স্বাস্থ্যবান দাস প্রায় ২০ থেকে ২২ টাকায় কেনা যেত। দাসদের দিয়ে দুই ধরনের কাজ করানো হতো, যা ছিল কৃষি এবং গার্হস্থ্য কাজ। তখন সমাজে গুটি কয়েক দাস রাখা একটি সামাজিক মর্যাদার ব্যাপার ছিল। তা ছাড়া উচ্চবিত্তরা তাদের দাসদের দিয়ে বিভিন্ন কৃষিকাজ করাতেন। দাসীদের সাধারণত রাখা হতো যৌন লোভ-লালসা পূরণ করার জন্য। তাদের উপপতœী করে রাখা হতো এবং তাদের সন্তানদেরও দাসরূপে রাখা হতো বা বিক্রি করা হতো। ব্রিটেনের সরকার এই দাসপ্রথা নিরুৎসাহিত করে এবং ১৮৪৩ সালে অ্যাক্ট ফাইভ আইন দ্বারা দাসদাসী আমদানি ও রফতানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়।
দাসপ্রথা একটি অনুমোদিত সামাজিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় বাজারে মানুষের আনুষ্ঠানিক বেচাকেনা চলত এবং ক্রীত ব্যক্তি ক্রেতার ব্যক্তিগত সম্পত্তি রূপে কাজ করতে বাধ্য থাকত। প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রায় সব শাসনব্যবস্থাতেই দাসপ্রথার প্রচলন ছিল। গবাদি পশুর মতো মানুষেরও কেনাবেচা চলত। অন্যান্য প্রায় সব দেশের মতো বাংলায়ও প্রাচীনকাল থেকেই দাসপ্রথা প্রচলিত হয়ে আসছিল।
কিন্তু বর্তমানে আনুষ্ঠানিকভাবে এ প্রথা চালু না থাকেলও অনানুষ্ঠানিকভাবে টিকে রয়েছে। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ওয়ার্ক ফ্রি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৪ কোটি ৫৮ লাখ মানুষ আজও দাসের মতো জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশেও ১৫ লাখ মানুষের জীবনযাপন দাসদেরই মতো।
অস্ট্রেলীয় মানবাধিকার সংস্থা গ্লোবাল সেøভারি ইনডেক্সের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে যে ৪ কোটি ৫৮ লাখ মানুষ ‘আধুনিক দাসের’ জীবন অতিবাহিত করছে তাদের ৫৮ শতাংশই ভারত, চীন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও উজবেকিস্তানের বাসিন্দা। সংস্থার ২০১৪ সালের সমীক্ষায় বিশ্বজুড়ে ৩ কোটি ৫৮ লাখ মানুষের আধুনিক দাসের জীবনযাপনের কথা বলা হয়েছিল। সে হিসাব এক বছরের ব্যবধানে এ তালিকায় আরো এক কোটি মানুষের সংযোজন হতাশাব্যঞ্জক।
দাসের সঙ্গে তুলনীয় অমানবিক জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে এমন মানুষ সবচেয়ে বেশি ভারতে। অর্থনীতির বিচারে ভারত এখন শীর্ষপর্যায়ের দেশে উন্নীত হলেও, সে দেশের ১ কোটি ৮৩ লাখ মানুষের জীবন প্রায় দাস যুগের গ-িতে বাঁধা। তারপর রয়েছে বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি বলে কথিত সমাজতান্ত্রিক দেশ চীন। চীনের ৩৪ লাখ মানুষ এখনো দুর্দশাগ্রস্ত জীবনযাপন করছে। মধ্যযুগের মনমানসিকতায় আবর্তিত পাকিস্তান দাসত্ব জীবনযাপনের দিক থেকে তৃতীয় স্থানে। এ দেশটির ২১ লাখ মানুষ লজ্জাজনক অবস্থানে বসবাস করছে। দশম স্থানে বাংলাদেশের অবস্থান এবং এ দেশের ১৫ লাখ অর্থাৎ শতকরা প্রায় ১ শতাংশ মানুষ প্রায় দাসের মতো জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে।
এশিয়া ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের তথ্যমতে, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ পাচারের শিকার হচ্ছে। জাতীয় মহিলা সমিতির তথ্য, এ সংখ্যা ২০ হাজার। ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়ার মতে, ৫০ হাজার লোক পাচারের শিকার হচ্ছে। মানব পাচারের উৎসস্থল নারী-পুরুষ ও শিশুরা জোর করে শ্রম ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে ভারত ও পাকিস্তানে পাচার হওয়া নারী-শিশুদের ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভারত সরকারের এক তথ্যে জানা যায়, মুম্বাইয়ের বিভিন্ন যৌনপল্লী থেকে ১৫০, দিল্লি থেকে ৮০ বাংলাদেশি নারীকে উদ্ধার করে দুই শহরে বিভিন্ন পুনর্বাসন কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মিজোরাম, ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের ৪ হাজার ৯৬ কিমি, সীমান্ত রয়েছে। ইতোমধ্যে সীমান্ত দিয়ে পাচার রোধে একটি নির্দেশনা জারি করেছে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ইউএনডিপির তথ্য অনুযায়ী এক দশকে বাংলাদেশ থেকে ১২ থেকে ৩০ বছর বয়সী প্রায় ৩ লাখ নারী ও শিশু পাচার হয়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার, নারী ও শিশুকল্যাণ সংগঠনের গবেষণা পরিষদের প্রতিবেদনে জানা যায়, গত তিন দশকে বাংলাদেশ থেকে ১০ লাখের বেশি মানুষ পাচার হয়েছে। সবচেয়ে বেশি পাচারের শিকার হয়েছে সীমান্তবর্তী জেলার বাসিন্দারা।
পাচারকৃতদের অঙ্গহানি করে ভিক্ষাবৃত্তি, মাদক বহন, যৌনবৃত্তি, গৃহকর্মী, পণ্যের চলচ্চিত্র, উটের জকি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এখন গার্মেন্টের নারীশ্রমিকরা পাচারকারীদের টার্গেটে পরিণত হচ্ছেন। আধুনিক এই যুগে বিশ্বের সাড়ে চার কোটিরও বেশি মানুষের দাসত্বের জীবন বেমানান ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী বাংলাদেশের ১৫ লাখ মানুষও একই দুর্ভাগ্যের শিকার। এ লজ্জা কাটিয়ে উঠতে সারা জাতিকেই তৎপর হতে হবে।
লেখক : গবেষক, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
"