এস এম মুকুল

  ২৩ জানুয়ারি, ২০১৮

স্মরণ

দেশপ্রেমের অনন্য পাঠশালা

অহিংসায় নয়, উদারতায় নয়, শক্তি প্রয়োগ করেই ব্রিটিশকে ভারত থেকে তাড়াতে হবেÑএই মন্ত্রকে ধারণ করে ব্রিটিশ শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়াই-সংগ্রাম চালিয়েছেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। ভারতের যুব সম্প্রদায়কে নেতাজি বলেছিলেনÑ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’ হিন্দিতেÑ‘তুম মুঝে খুন দো, ম্যায় তুমহে আজাদি দুঙা’Ñ৪ জুলাই ১৯৪৪ সালে বার্মাতে এক শোভাযাত্রায় তিনি এই উক্তি করেন। নেতাজির আরেকটি বিখ্যাত উক্তি ‘ভারতের জয়’ বা ‘জয় হিন্দ’, যা পরে ভারত সরকার গ্রহণ করে নেয়। উপমহাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনেরও অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন তিনি। সাংস্কৃতিক দিক থেকে তিনি মনেপ্রাণে ছিলেন বাঙালি। যেকোনো মূল্যায়নেই এ কথা প্রমাণিত হবে, ভারত উপমহাদেশে সশস্ত্র বিপ্লববাদীদের সংগঠক হিসেবেও নেতাজি অনন্য অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। সম্ভবত এ কারণেই বিপ্লবী যোদ্ধারা তাকে নেতাজি বলতেন। বিপ্লবী সুভাষ চন্দ্র বসু সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি প্রকৃত অর্থেই জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিক এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম কা-ারি। দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে আত্মত্যাগের অপার মহিমায় উপমহাদেশে এবং ভারতবাসীর কাছে নেতাজির স্থান হিমালয়সদৃশ্য। তার আদর্শ, মূল্যবোধ, রাজনৈতিক ভাবনা ও কর্মকা- চিরকাল মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে। বিভিন্ন বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, সুভাষ চন্দ্র বসুর রাজনৈতিক চেতনা ও দেশপ্রেম সম্পর্কে তার অনুভব গড়ে উঠেছে কৈশোরকালের একনিষ্ঠ বিবেকানন্দভক্তি, ছাত্রাবস্থায় দেশের সম্মান রক্ষায় ইংরেজ শিক্ষকের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ তরুণ, যৌবনকালে যিনি অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের কাছ থেকে প্রেরণা লাভ করেছেন এবং ক্রমেই সংসদীয় ব্যবস্থাকে ব্যবহার করেও আপসহীন দেশপ্রেমিক রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছেন।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের কিংবদন্তি যে নেতাকে ঘিরে এখনো রহস্যাবৃত্তÑতার নাম নেতাজি সুভাষ চন্দ্র। রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে একটি অনন্য আর্কাইভ। আর দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে নেতাজি নামটি যেন এক অমর দীক্ষালয়Ñঅনন্য জ্ঞান রহস্যের পাঠশালা। তিনি এমনই একজন মানুষ যিনি আরাম-আয়েশ ছেড়ে বেছে নিয়েছিলেন সংগ্রামের কঠিন পথ। সেই সংগ্রাম ছিল ব্রিটিশদের শাসন থেকে মুক্ত ভারতের স্বাধীনতার স্বাদ। তিনি দেশপ্রেমে তার নিবেদনকে এভাবেই ব্যক্ত করেছেনÑ‘আমার মনে হয় যে দেশমাতৃকার কল্যাণের জন্য যদি আমাকে সারাজীবন কারাগারে যাপন করতে হয়, আমি তাতে মোটেও পশ্চাৎপদ হব না।’ কজন রাজনীতিকই-বা পারে এমন নির্মোহ ত্যাগের মহিমা ছড়াতে। বিশ্বাস ছিল, আবেদন-নিবেদন ও তোষামোদ করে স্বাধীনতা আদায় করা সম্ভব হবে না। স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হয় সংগ্রাম করে, যুদ্ধ করে, রক্তের বিনিময়ে। তাই তার রাজনৈতিক জীবনের প্রথম থেকেই কংগ্রেসের পাশাপাশি বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবীদের সংগঠিত করতে থাকেন। কার্যত তখন থেকেই তিনি একদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে, অন্যদিকে বাংলার বিপ্লবী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন। বিপ্লবীরাও তাকে নিজেদের নেতারূপে কংগ্রেসের রাজনীতিতে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। ১৯২১ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত সুভাষ বসু কলকাতা, ঢাকাসহ বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিপ্লবী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের স্থাপন করেন।

যদিও নেতাজির রাজনৈতিক জীবন বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। কারো ক্ষেত্রেই তা সম্ভবও নয়। তথাপি নেতাজির রাজনৈতিক দীক্ষা-দৃঢ়তা সর্বময় উপমাসাদৃশ্য। কংগ্রেস কমিটি যেখানে ভারতের অধিরাজ্য মর্যাদা বা ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের পক্ষে মত প্রদান করে, সেখানে সুভাষ চন্দ্রই প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে মত দেন। তখন জওহরলাল নেহরুসহ অন্যান্য যুবনেতারা তাকে সমর্থন করেন। শেষ পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশনে কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজ মতবাদ গ্রহণে বাধ্য হয়। সুভাষ চন্দ্র বসু প্রস্তাব করেন, কবে ব্রিটিশরা ভারতীয়দের স্বাধীনতার অনুমোদন দেবে তার জন্য বসে না থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে সুবিধা নেওয়া উচিত। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা নির্ভর করে অন্য দেশের রাজনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থনের ওপর। তাই তিনি ভারতের জন্য একটি সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। রাজনৈতিক ক্ষমতারোহণের কারণেই মহিমান্বিত এই মহাপুরুষের সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি। কিন্তু মহাকালের ইতিহাসের বিচারে একদিন সব সত্যই সামনে চলে আসবে। স্বাধীন ভারতে তাকে নিয়ে যেসব কল্পকাহিনির সৃষ্টি করা হয়েছে, এসবের ঐতিহাসিক কোনো গুরুত্ব নেই। সুভাষ বসুর বাল্যকাল ও কৈশোর কেটেছে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের উত্তপ্ত পরিবেশে। এই আন্দোলন সারা ভারতবর্ষেও রাজনৈতিক অঙ্গন প্রকম্পিত করে তুলেছিল। স্কুলে যখন পড়তেন তখন সুভাষ দেখেছিলেনÑবিপ্লবী গুরু অরবিন্দ ঘোষকে বিপ্লবী প্রচেষ্টায় অক্লান্ত পরিশ্রম করতে, প্রফুল্ল চাকী ও প্রফুল্ল চক্রবর্তীর আত্মাহুতি, ক্ষুদিরাম বসু, কানাই লাল দত্ত, সত্যেন বসু, চারু বসু, বীরেন দত্তগুপ্তকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে। কলেজে পড়াকালীন সময়ে দেখেছেন প্রখ্যাত বিপ্লবী নেতা রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বে ভারতবর্ষে সেনাবাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ সংঘটিত করতে, বিপ্লবী বাঘা যতীনকে তার চার সহকর্মী চিত্তপ্রিয় চৌধুরী, নীরেন দাশগুপ্ত, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, যতীশ পালসহ ব্রিটিশ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে শহীদ হতে। এসব দৃশ্যপটই বোধহয় তার মধ্যে দেশপ্রেমের চেতনার স্ফুরণ ঘটিয়েছে। নেতাজি যখন স্বাধীনতা সংগ্রামী চিত্তরঞ্জন দাসের সঙ্গে রাজনীতি শুরু করেন। তখন তিনি কলকাতা করপোরেশনের চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার হিসেবে নিযুক্ত হন। চিত্তরঞ্জন দাস তখন কলকাতা করপোরেশনের মেয়র। সুভাষ চন্দ্র বসুর মাসিক বেতন তিন হাজার টাকা। কিন্তু তিনি পনেরো শ টাকা বেতন নিতেন। বাকি টাকা স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শে নিয়োজিতদের পেছনে ব্যয় করতেন।

নেতাজি বলেছেন, ‘সমস্ত প্রাণ দিয়া কি আমরা জননী ও জন্মভূমিকে ভালোবাসি? জননীকে ভালোবাসার অর্থ শুধু নিজের প্রসূতিকে ভালোবাসা নয়, সমস্ত মাতৃজাতিকে ভালোবাসা’। দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি তার ভালোবাসায় কোনো খাঁদ ছিল না। তাই হয়তোবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুভাষ চন্দ্রকে ‘দেশনায়ক’ আখ্যা দিয়ে তাসের দেশ নৃত্যনাট্যটি তাকে উৎসর্গ করেন। সুভাষ চন্দ্র তার স্বপ্নের ভারতের কথাগুলো ব্যক্ত করেছিলেন, ‘যে স্বপ্নে আমরা বিভোর হয়েছি তা শুধু স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন নয়। আমরা চাই ন্যায় ও সাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত এক স্বাধীন রাষ্ট্রÑ আমরা চাই এক নতুন সমাজ ও এক নতুন রাষ্ট্র, যার মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠবে মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ ও পবিত্রতম আদর্শগুলো।’ ১৯৪২ সালের মার্চ মাসে জাপানের রাজধানী টোকিওতে ভারতীয়দের একটি সম্মেলনে গঠিত হয় ‘ইন্ডিয়ান ইনডিপেনডেন্স লিগ’ বা ‘ভারতীয় স্বাধীনতা লিগ’। ১৯৪২ সালে ব্যাংককে আরো একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনেই রাসবিহারী বসুকে লিগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয় এবং আজাদ হিন্দ বাহিনী (ইংরেজিতে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা আইএনএ) নামে একটি সামরিক বাহিনী গডে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জাপানিদের হাতে যুদ্ধবন্দি ৪০ হাজার ভারতীয় সেনা নিয়ে গড়ে ওঠে আজাদ হিন্দ ফৌজ। ক্যাপ্টেন মোহন সিং ফৌজের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। ওই সম্মেলনেই সুভাষ চন্দ্র বসুকে আমন্ত্রণ জানানো হয় আজাদ হিন্দ ফৌজের ভার স্বহস্তে গ্রহণ করার জন্য। সুভাষ চন্দ্র ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে সিঙ্গাপুরে এসে ফৌজে যোগ দেন। রাসবিহারী বসু সুভাষ চন্দ্রের হাতে আজাদ হিন্দ ফৌজের ভার তুলে দেন। বাহিনী সুভাষ চন্দ্রকে অভিবাদন জানায় ‘নেতাজি’ নামে। সিঙ্গাপুরেই নেতাজি স্থাপন করেন আরজি-হুকুমত-এ-আজাদ হিন্দ বা অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকারের।

নেতাজির ভাষ্যেÑ‘আমার এই ক্ষুদ্র অথচ ঘটনাবহুল জীবনে যেসব ঝড় আমার ওপর দিয়া বহিয়া গিয়াছে, বিভিন্ন বিপদের সেই কষ্টিপাথর দ্বারা আমি নিজেকে সূক্ষ্মভাবে চিনিবার ও বুঝিবার সুযোগ পাইয়াছি। এই নিবিড় পরিচয়ের ফলে আমার প্রত্যয় জন্মিয়াছে যে, যৌবনের প্রভাবে যে কণ্টকময় পথে আমি জীবনের যাত্রা শুরু করিয়াছি, সেই পথে শেষ পর্যন্ত চলিতে পারিব। অজানা ভবিষ্যৎকে সম্মুখে রাখিয়া যে ব্রত একদিন গ্রহণ করিয়াছিলাম তাহা উদযাপন না করিয়া বিরত হইবো না।’ এমন দৃঢ় প্রত্যয় কজনই বা করতে পারে।

ভারতকে ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীন করার ইচ্ছায় যিনি তৎকালীন সময়ের সরকারি চাকরি ত্যাগ করেছিলেন নেতাজি হচ্ছেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। গান্ধীজির সঙ্গে সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হলেও গান্ধীজির অহিংস আন্দোলনের প্রতি তার কোনো আগ্রহ ছিল না। গান্ধীজিকে ছেড়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সান্নিধ্যে থেকে তিনি নিজেকে রাজনীতিতে আরো পরিপক্ব করে গড়ে তোলেন। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু জন্মেছিলেন ১৮৯৭ সালে ২৩ জনুয়ারি। উড়িষার কটক শহরে এক বাঙালি পরিবারে। তার জন্ম কলকাতায় হলেও তাদের পৈতৃক নিবাস ছিল চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত কোদালিয়া গ্রামে। বাবা জানকীনাথ বসু।

লেখক : অর্থনীতি ও সমাজবিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist