রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২২ জানুয়ারি, ২০১৮

মতামত

নেশায় বুঁদ যুবসমাজ

বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে তরুণদের উদ্দীপনাময় শক্তি স্বপ্ন আজ থেমে গেছে মাদকের ভয়াল গ্রাসে। তাই দেখা যায়, বিগত বছরগুলোয় মাদক বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভয়াবহ নেশায় পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, মাদক বর্তমান যুবসমাজকে কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে, এর পরিণতি কী? সর্বনাশা এ নেশা থেকে বেরিয়ে আসা অনেকটা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশ, জাতি ও সমাজের উজ্জ্বল নক্ষত্র আজকের যুব বা তরুণসমাজ। কিন্তু তারা যেভাবে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছেÑ এই নিয়ে জনমনে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। এর কুপ্রভাবে যেভাবে আমাদের তারুণ্য শক্তি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত, তা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে আমাদের তরুণসমাজের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। শিক্ষিত, অশিক্ষিত হতাশাগ্রস্ত এক শ্রেণির বেকার তরুণরা এই সর্বনাশা পথে পা বাড়িয়েছে। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত এমনকি সমাজের ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানরাও মাদকে আসক্ত। একবার ভাবুন তো ঐশীর কথা। তার বাবা ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। ২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট রাজধানীর চামেলীবাগে নিজ বাসায় খুন হন পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান। কিন্তু খুনি! খুনি আর কেউই নয় তাদের একমাত্র মেয়ে ঐশী রহমান। ঐশী একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়তে গিয়ে কতগুলো বখাটে বন্ধুর সঙ্গ পেয়েছিল। তাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে সে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। ঐশীর আচার-আচরণে পরিবর্তন দেখা দিলে তার বাবা-মা বিষয়টি জানতে পারে এবং তাকে কড়া শাসনে ভালো পথে আনার চেষ্টা করে। এতে ঐশী আরো ক্ষিপ্ত হয় এবং এক পর্যায়ে নিজ হাতে খুন করে বাবা-মাকে। কোনো পরিবারে মাদকাসক্ত সন্তান থাকলে পরিবারে যেমন অশান্তি নেমে আসে, তেমনি ভয়ভীতিও থাকে। ঐশীর মতো মাদকাসক্ত সন্তানরা খুন করছে বাবা-মাকে।

১৬ কোটি মানুষের এ দেশে প্রায় এক কোটি মানুষ মাদকাসক্ত। নেশার ছোবলে পড়ে এ দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মাদকের পেছনে ছুটছে। আমাদের দারুণভাবে শঙ্কিত এবং উদ্বিগ্ন করে, এক শ্রেণির কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও মাদকে আসক্ত হয়েছে। খারাপ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে এসব শিক্ষার্থী কখন যে আমাদের মনের আড়ালে, চোখের আড়ালে, মনের অজান্তে বিভিন্ন মাদকদ্রব্যে আসক্ত হয়ে পড়ে তা আমরা জানি না। বাংলাদেশে ইয়াবা, মদ, গাঁজা, চরস, আফিম, ঘুমের ওষুধ, হেরোইন, ফেনসিডিল প্রভৃতি মাদকদ্রব্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে এসব মাদকদ্রব্যের মধ্যে ইয়াবা, ভায়াগ্রা, হেরোইন, ফেনসিডিলে আসক্ত হচ্ছে বেশি। অথচ এগুলো নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি স্বাভাবিকভাবে মানুষের আগ্রহ একটি বেশি এবং একই সঙ্গে কৌতূহলের জন্ম নেয়। তাই কৌতূহলবশত এগুলোর প্রতি তরুণদের আসক্তি সৃষ্টি হয় এবং ধীরে ধীরে তারা এর সংস্পর্শে আসে। তারপর তাদের মধ্যে এক ধরনের নতুন ও রঙিন অনুভূতি কাজ করে। এভাবে তারা নেশার জগতে পা বাড়ায় এবং মাদক তাদের এমনভাবে গ্রাস করে যে, সেখান থেকে ফিরে আসা তাদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। মাদকের ভয়াল থাবায় আজ বিপন্ন তরুণ। স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সর্বত্র আজ মাদকের ছড়াছড়ি। পারিবারিক সম্পর্ক শিথিল হওয়া তিক্ততা, বেকারত্ব, নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবে দিন দিন মাদক আসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। মাদক যেহেতু বিনামূল্যে পাওয়া যায় তাই উঠতি বয়সের ছেলেরা বাবার পকেট চুরি এমনকি ছিনতাই করেও অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে তারা নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।

মাদক সেবনের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয় ১৫ থেকে ৩০ বছরের বয়সীদের মধ্যে। মাদকসেবীর মধ্যে ৮০ শতাংশই তরুণ। তাদের ৪০ শতাংশ আবার বেকার। এদের ৫০ শতাংশ অপরাধের সঙ্গে জড়িত। মাদক এখন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। তরুণদের পাশাপাশি তরুণীরাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। মাদকের নীল ছোবলে কোমল হাত পরিণত হচ্ছে ভয়ংকর খুনির হাতে। ঐশীই তার বড় প্রমাণ। তরুণরা একটি দেশের প্রাণশক্তি। অনেক কবি, সাহিত্যিক তারুণ্য শক্তির জয়গান গেয়েছেন। তরুণরা একটি দেশের ভবিষ্যৎ স্বপ্নদ্রষ্টা। তাদের মধ্যে যে শক্তি সাহস-উদ্দীপনা রয়েছে তা যদি দেশের কল্যাণে মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হয়। তাহলে তা হবে একটি জাতির জন্য অবশ্যই আশীর্বাদস্বরূপ। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় তরুণদের একাংশ আজ বিপথগামী। তারা বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকা-ে জড়িত। বিশেষ করে মাদকের নীল ছোবলে তাদের ভবিষ্যৎ আজ অন্ধকার মাদক চোরাকারবারি বা সরবরাহকারীর রয়েছে বিশাল নেটওয়ার্ক। এসব চোরাকারবারির সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশের এক বিশেষ শ্রেণি। তাদের যোগাযোগ রয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। তারা অত্যন্ত সংগোপনে মাদক তুলে দিচ্ছে তাদের সহযোগীদের। তারা এসব সহযোগীর হাত থেকে ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল প্রভৃতি মাদকদ্রব্য চলে যাচ্ছে তাদের খদ্দরের হাতে। চলে যাচ্ছে তরুণ যুবসমাজের হাতে। তাই মাদকদ্রব্য উৎপাদন থেকে সাধারণ খদ্দরের কাছে পৌঁছাতে বেশ কয়েকবার হাতবদল হয়। ভৌগোলিক দিক থেকে বাংলাদেশে মাদক অতি সহজে পাওয়া যায়। আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ মাদকের মরণনেশা থেকে তরুণদের বাঁচানো।

সীমান্তরক্ষীদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার মাদক বাংলাদেশের তরুণদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে যার প্রভাবে তরুণসমাজের একাংশ বিপথগামী মাদকের ভয়াল থাবায়। মাদকের হিংস্র ভয়াবহ ছোবলে আমাদের সন্তানরা আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। মাদক যে শুধু ঢাকা বা বড় বড় শহরে এর ব্যাপ্তি তা নয় মাদকের যত্রতত্র ব্যবহার হচ্ছে গ্রাম, গঞ্জে এমনকি পাড়া-মহল্লায়। তবে মাদকদ্রব্যের প্রতি বেশি আসক্ত হচ্ছে বেকার, ভবঘুরে হতাশাগ্রস্ত তরুণরা। এ মরণনেশার ছোবলে একদিকে যেমন সামাজিক অপরাধ বাড়ছে। অন্যদিকে সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে। তাই বলার অপেক্ষা রাখে না যে মাদক এখন তরুণ-তরুণীদের মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। এর ভয়াল থাবা প্রতিহত করতে আমাদের যেমন সচেতন হতে হবে, তেমনি সরকারি উদ্যোগেরও প্রয়োজন রয়েছে। গণমাধ্যম থেকে আমরা জানতে পারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ব্যাপারে সতর্ক, মাদকসহ অনেককে আটকের খবরও আমরা পাই। দেশে মাদক নিয়ন্ত্রণ দফতও রয়েছে। তবু এ মাদকের ব্যবহার ঠেকানো যাচ্ছে না, যা আমাদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। মাদকের নীল ছোবলে তরুণরা আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশে মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে ৬৮ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত। এদের মধ্যে ৮৪ ভাগ পুরুষ এবং ১৬ ভাগ নারীও রয়েছে। দেশজুড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আবার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মতে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৪৭ লাখ। যার মধ্যে ৯০ শতাংশই কিশোর, তরুণ হিসেবে পরিচিত। মদ, গাঁজা, হেরোইন, এসব মাদক মানুষের স্বাভাবিক জ্ঞান, বিবেক, অনুভূতিকে হ্রাস করে।

তা ছাড়া নেশায় আসক্ত হয়ে তারা ক্রমাগতভাবে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। তারা এতটা ভয়ংকর হয়ে ওঠে, হিতাহিত জ্ঞান না থাকায় তারা অতি আপনজন কেউ খুন করে। সাম্প্রতিককালে ঐশী রহমানই তার প্রমাণ। ঐশী ছাড়াও এর অনেক প্রমাণ রয়েছে। আমাদের প্রত্যেক অভিভাবককে তাদের সন্তানদের খোঁজখবর নেওয়া উচিত। সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তাদের ভালো-মন্দের শেয়ার করা উচিত। আসলে আমাদের ছেলেমেয়েদের কোনো খোঁজখবর আমরা অনেকে রাখি না। অধিকাংশ অভিভাবকই তাদের সন্তানদের ব্যাপারে উদাসীন। এমনকি তার স্কুল বা কলেজপড়ুয়া সন্তান নিজ শয়নকক্ষে কী করছে সে খবরও অনেক অভিভাবক রাখেন না। তাদের সহপাঠী বা বন্ধু-বান্ধব কেমন প্রকৃতির কাদের সঙ্গে মিশে এ সম্পর্কে অভিভাবকদের খোঁজ নেওয়া দরকার। বেকারত্ব, হতাশা, পারিবারিক বন্ধন হালকা, খারাপ বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা ইত্যাদি কারণে আমাদের সন্তানরা বিগড়ে যায় এবং মাদকে আসক্ত হয়। মাদকসেবীর অধিকাংশই কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, যাদের ওপর দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। অথচ তারা আজ বিপথগামী, ধ্বংসের মুখে, মাদকের ভয়াল থাবায় বিপন্ন। যাদের ওপর দেশের অগ্রগতি, উন্নয়ন, ভবিষ্যৎনির্ভর করছে তাদের একাংশ যদি পথভ্রষ্ট হয়, ইয়াবা, ফেনসিডিল মাদকের আসক্ত হয় তাই তাদের সঠিক পথে ফিরে আনা অত্যন্ত জরুরি। কোনো রাষ্ট্রে যদি আইনের শাসন, ন্যায়-বিচার সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ঘাটতি থেকে যায় সে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অপরাধসহ সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করে। মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে আমাদের সচেতন হতে হবে।

লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist