এস আর শানু খান

  ২১ জানুয়ারি, ২০১৮

বিশ্লেষণ

শিক্ষাব্যবস্থায় অনিয়ম ও কিছু কথা

আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কথায় একটু পরে আসি। চলুন আগে একটু ঘুরে আসি আফ্রিকা। আফ্রিকার একটা বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হলো ‘University Of South Africa’। যেটা ১৮৭৩ সালের ২৬ জুন প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ছিল University Of The Cape Of Good Hope । যে বিশ্ববিদ্যালয়ে সারা বিশ্বের প্রায় ১৩০টি দেশের ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করেন। বিশ্বের সব নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং ও একটা উল্লেখযোগ্য স্থান দখলে রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়টির। বিশ্ববিদ্যালয়টির একদম সিংহদ্বারে বড় করে লেখা রয়েছেÑ‘কোনো জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক হামলা কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের দরকার নেই। বরং সেই জাতির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় প্রতারণার সুযোগ দিলেই হবে। কারণ এভাবে প্রতারণার মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে তৈরি হওয়া ডাক্তারদের হাতে রোগীর মৃত্যু হবে। ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বারা দালান-কোঠা, ইমারত ধ্বংস হবে এবং অর্থনীতিবিদদের দ্বারা দেশের আর্থিক খাতসমূহ দেউলিয়া হবে। এ ছাড়া এভাবে তৈরি হওয়া বিচারকদের হাতে সে জাতির বিচারব্যবস্থার কবর রচনা হবে। ফলেই সে জাতির শিক্ষাব্যবস্থা অচিরেই ভেঙে পড়বে। আর কোনো জাতির শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মানে হলো সে জাতি শিগগিরই বিলুপ্ত হবে। ধ্বংস হবে।’ তার মানে এই যে, পারমাণবিক বোমার থেকেও শক্তিশালী ও ভয়ানক এক অস্ত্রের নাম হলো জালিয়াতি, প্রতারণা বা অনিয়ম এবং সেটা আবার যদি হয় কোনো দেশের শিক্ষাব্যবস্থায়। উপরোক্ত কথার ভাবার্থ এই যে, কোনো দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় জালিয়াতি বা অনিয়ম বা প্রতারণা ঢুকে গেলে সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তো গোল্লায় যায়ই এবং সে জাতি ধ্বংস হয়ে যায়। হবেই বা না কেন? যে শিক্ষক ক্লাসে ৩৩ পেয়ে গণিতে পাস করেছেন এবং বড় মাপের টাকা নয়তো ক্ষমতার অপব্যবহারে মাধ্যমে শিক্ষক হয়েছেন। সেই শিক্ষক একজন ৮০ পাওয়া ছাত্রের খাতা দেখবেন কোন অভিজ্ঞতায়? কথাটা বড়ই লজিক্যাল। জাল-জুয়া-চুরি আর ক্ষমতা নয়তো টাকার জোরে এক লাফে প্রজা থেকে রাজা হওয়া গেলেও সঠিক জ্ঞান ছাড়া কখনো জ্ঞানী বা বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব হওয়া যায় না। কিন্তু আমাদের দেশে এখন সেটাই হচ্ছে। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, যেখান থেকে দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার বের হবে সেখানেই এখন সবচেয়ে বড় ঘাবলা। বড় জালিয়াতি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজ হলো জ্ঞানের আলো ছড়ানো কিন্তু একবার চোখ খুলে দেখুন আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো জ্ঞানের আলোর পরিবর্তে অজ্ঞান করার ওষুধ সরবরাহ করছেন। একটা কর্মঠ, তেজস্বী, বুদ্ধিদীপ্ত, মেধাবী জাতিকে ক্রমেই অচেতন করে তুলছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানেই এখন বাণিজ্য। ভর্তি-বাণিজ্য। প্রশ্ন ফাঁসের মতো ধারাবাহিক নাটকের পুনরাবৃত্তি। মেধার দরকার নাই, টাকা হলেই ভর্তি হওয়া যায় যেখানে-সেখানে। পরীক্ষা হলে গিয়ে প্রশ্ন নয়। পরীক্ষার সপ্তাহখানেক আগেই হুবহু ১০০ শতাংশ কমন প্রশ্ন পাওয়া যায় মার্কেটে। শুধু এখানেই শেষ নয় দেশের রাজনৈতিক রেষারেষির ধারা বজায় রেখে যখন যে সরকারই ক্ষমতায় আসেন তিনি চান আগের সরকারের চেয়েও সব দিক থেকে এগিয়ে নিতে দেশকে। আসলে কতখানি এগোলো সেটা বিষয় নয়। কেননা সেটা কেউই জানতে চাইবেন না। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, ইচ্ছা করলেও জানতে পারবেনও না। কোনো রকম আমড়া হলেই চলবে হোক শুধু আটি আর চামড়া তবু তো আমড়া। ঠিকই তেমনই আমাদের দেশ চাইছে পাসের হার বাড়াতে, শিক্ষিতের হার বাড়াতে। তাই তো শিক্ষাব্যবস্থার আসল নিয়ম-নীতিকে ঝোলায় তুলে খেলনাসামগ্রী নিয়ে শিক্ষাঙ্গন ভর্তি করে শিক্ষিতের হার বাড়ালেও শিক্ষা বাড়ছে না। বাড়ছে মেধা। তৈরি হতে পারছে না সঠিক সৈনিক। হতে পারল না সঠিক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা অর্থনীতিবিদ। গোঁজামিল দিয়ে ডাক্তারি পাস করা ডাক্তার তো গোঁজামিল দিয়েই রোগীর চিকিৎসা করাবেনÑএটাই স্বাভাবিক। ঠিক একইভাবে গণিতে ফেল করা অর্থনীতিবিদ তো ভুল করে হিসাবে গরমিল ঘটাবেন এটাই স্বাভাবিক। এমনটা চলতে থাকলে আমড়া হয়তো আমড়াই থাকবেন কিন্তু ভেতরে আসল কোনো জিনিস থাকবে না। শুধু আঁটি আর চামড়াই অবশিষ্ট থাকবে শেষমেশ।

পরীক্ষায় নকল দেশ তথা সমগ্র জাতির জন্য এক অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রতিটি সচেতন নাগরিকই প্রত্যাশা করবেন যে পরীক্ষা নকলমুক্ত হোক। কিন্তু বাস্তবে দেখলে দেখা যায় শুধু পাবলিক পরীক্ষা নয় যেকোনো ধরনের পরীক্ষা মানেই রীতিমতো গণটোকাটুকি। আজকের ছাত্রসমাজের ভাবনা নকল করার মধ্যেই তাদের আসল ছাত্রত্ব নিহিত। নকল করাকে আজ প্রতিটি ছাত্র তাদের অধিকার হিসেবে ধরে নিয়েছে। একটা পরীক্ষা নেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে একটা ছাত্রের অর্জিত জ্ঞানের যথার্থতা যাচাই করা। সারা বছর পড়াশোনা করে সে কী শিখেছে, নিজের ভেতরটা জ্ঞানের আলোর দ্বারা কতটুকুই বা বিচলিত করতে পেরেছে সেটা বোঝার একমাত্র উপায় হচ্ছে একটা সুষ্ঠু ও নকলমুক্ত পরীক্ষা। তা না, উল্টে সারা বছর পড়াশোনা না করে পরীক্ষার হলে নকল করে ভালো রেজাল্টের সার্টিফিকেট গলায় ঝুলিয়ে বেড়ানোই যদি গৌরবের হয় তাহলে তো ধরে নিতে হয় অনিয়মই নিয়ম, দুর্নীতিই সুনীতি। বর্তমানে আমাদের দেশের পাবলিক পরীক্ষায় নকল এক মহামারী রূপ ধারণ করেছে, যেটা কিনা পুরো জাতিকেই গভীর অন্ধকারের দিকে ধেয়ে নিচ্ছে। অজ্ঞতার এক বিষাক্ত স্রোত সমগ্র জাতির বিবেককে গ্রাস করে নিচ্ছে।

আমার এক চাচাতো ভাই গেলবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। তা আমি প্রায়ই ওর পরীক্ষার খোঁজ নিতাম। কী পরীক্ষা হলো? কেমন হলো? প্রশ্নটাও খুঁটিয়ে দেখতাম। ইংরেজি পরীক্ষার দিন চাচাতো ভাইয়ের কাছে শুনলাম পরীক্ষা কেমন হয়েছে, হাসিখুশি একটু মুখ বানিয়ে জোরে জোরে হাফ ছেড়ে বলল সবচেয়ে বড় ঝুঁকিটা আজ কাটিয়ে আসলাম। ইংরেজি নিয়েই যত চিন্তা ছিল। গ্রামারেই পাস হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। শুনে আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, তুই তো ভাওয়েল ও কনসোনান্ট অক্ষরই চিনিস না, তাহলে তুই আবার গ্রামারে ও তো নম্বর কীভাবে পাবি। চাচাতো ভাই আমার ফিসফিস করে বলল, তাদের স্কুলে তাদের পরীক্ষার কেন্দ্র। তার জন্য তাদের স্যারেরা বিশাল সুযোগ-সুবিধা দেন। বেশির ভাগ প্রশ্নের সমাধান রীতিমতো স্যারেরাই করে দেন। বিশেষ করে ইংরেজিও দুই পেপার ও গণিতের দিন প্রতিটি রুমের জন্য স্যার নিয়োগ দেওয়া হয় শুধু পরীক্ষার্থীদের সাহায্য করার জন্য। শুনে চোখ কপালে উঠল আমার। তার পরও কৌতূহল নিয়েই বিষয়টা ভালো করে ইনিয়ে-বিনিয়ে শুনলাম ওর কাছে। ওদের স্কুলে পরীক্ষার সেন্টার। আর এই সেন্টারে যদি ভালো রেজাল্ট না হয় তাহলে আর পরীক্ষার কেন্দ্র এখানে থাকবে না। অন্য স্কুলে চলে যাবে। সে জন্যই স্যারেরা একদম বন্ধুর মতোই পরীক্ষার হলে গিয়ে আপনা-আপনি বলে দেন। বেশ মজা পেলাম। আহারে... কী প্রেম!! শিক্ষক-ছাত্রের এক মধুর প্রেমলীলা শুনে অবাক হলাম। কোথায় গিয়ে ঠেকেছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। কী হবে ভবিষ্যতে।

পরীক্ষায় নকল জাতির জন্য এক মারাত্মক অভিশাপ। এই অভিশাপ থেকে বাঁচতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিপুল পরীবর্তন আনতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কের দিকটা কোথায় কেমন হওয়া উচিত সেটা সুনিশ্চিত করতে হবে আগে। দেশের সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষক, ছাত্র, প্রশাসন তথা প্রতিটি পরীক্ষার সঙ্গে বিশেষ করে পরীক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে দায়িত্ব আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে দেশের শিক্ষামন্ত্রীকে শিক্ষক, প্রশাসনের কর্মকর্তা, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, অভিভাবক এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে গণমাধ্যমকে সঙ্গে নিয়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চষে বেড়াতে হবে। নকলের কুপ্রভাব ও ভয়াবহতা এমনকি নকলের সঙ্গে সম্পৃক্তদের কঠিন শাস্তির বিধান চালুসাপেক্ষ কড়া বক্তব্যসংবলিত সভা, সেমিনার, মতবিনিময় সভা, টিভিতে টকশোসহ সচেতনামূলক পদ্ধতিগুলো নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। পরীক্ষার সময় সারা দেশের কেন্দ্রগুলোয় সাঁড়শি অভিযান চালাতে হবে। অধিক পাসের হার নিশ্চিত কিংবা ভালো রেজাল্টের নেশায় মত্ত হয়ে উঠলে চলবে না। উদ্দেশ্য হতে হবে আদর্শ জাতি গড়ার।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist