শামীম শিকদার
মতামত
অতিথি পাখি ও কিছু কথা
প্রচন্ড শীতে যখন বাঁচা-মরার প্রশ্ন দেখা যায়, দেখা যায় খাদ্য ও আশ্রমের চরম সংকট। শীতপ্রধান দেশের পাখিরা উষ্ণতা, আর্দ্রতা ও শ্যামলিমার আশায় হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে হিমালয়ের পাদদেশ ও রাশিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে চলে আসে বাংলাদেশে । আর শীতকালে শীতের হাত থেকে বাঁচতে যেসব পাখি তাদের নিজ দেশ ছেড়ে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চলে চলে আসে, তাদের বলা হয় অতিথি পাখি বা পরিযায়ী পাখি। এ পাখিগুলো দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি সুন্দর তাদের গায়ের বাহারি রং। ঝাঁকে ঝাঁকে যখন তারা উড়ে বেড়ায়, তখন যে কেউ তাদের দিকে না তাকিয়ে পারবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, অতিথি পাখি এখন আর আমাদের দেশে অতিথি হয়ে থাকতে পারছে না, তারা খাদ্যের জন্য শিকার হচ্ছে একশ্রেণির ব্যবসায়ীদের হাতে। শুধু ব্যবসায়ীরা নন, শৌখিন শিকারিদের হাতেও শিকার হয়ে থাকে হাজার হাজার পাখি। উপকূলীয় বিভিন্ন উপজেলার বড় বড় হাওরের জলাশয়ে খাবারের সন্ধানে প্রতিবছরই শীত মৌসুমে এসে জড়ো হয় বিভিন্ন প্রজাতির বালিহাঁস, ল্যাঞ্জা হাঁস, চখাচখি, মানিকজোড়, গাংকবুতর, নারুদ্দী, চীনা হাঁস, নাইরাল ল্যাঙ্গি, ভোলাপাখি, হারিয়াল, বনহুর, বুরলি হাঁস, সিরিয়া পাতিরী, পিয়াংচীনা, কাবালি, যেনজি, প্রোভায়, নাইবাল, ডেলা ঘেনজি, গ্রাসওয়ার, গেন্ডাভার, বারহেড, চখা পানকৌড়ি, ডাহুক, তীরগুল, নলকাক, ভাড়ই, রাংগাবনী, রাতচড়া, হুটটিটি, জলপিপি, কোম্বডাক, হুরহুর, খয়রা, সোনা রিজিয়া, সরালি ও কাইমসহ শত প্রজাতির অতিথি পাখি। বিশেষ করে মিরপুর চিড়িয়াখানা, মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাশের লেক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, ঢাকার পিলখানা, বালুচর, মহেশখালী দ্বীপ, চরপিয়া, নিঝুম দ্বীপ, হাতিয়া দ্বীপ, ডালচর, যামিরচর, মৌলবীবাজার, টাঙ্গুয়ার হাওর, জোনাকচর, চরভাটা, র্শিবালয়, কামালপুর, হালহাওর, হাকালুকি হাওর, চরকুকড়িমুকড়ি, বুড়িগঙ্গা নদী, আগুনমুখা, গলাচিপা, খেপুপাড়া, কুয়াকাটা, ঘাটিভাঙা, কলাদিয়া, চরণদ্বীপ, হোয়াইকিয়ং, শাহপুরীর দ্বীপ, মনপুরা, সোনারচর, চরনিজাম, চরমানিক, চরদিয়ার, চরমনতাজ, নেত্রকোনার কলমাকান্দার হাওর, কিশোরগঞ্জ হাওর, সুনামগঞ্জ হাওর, পঞ্চগড়ের ভিতরগড়সহ বিভিন্ন অঞ্চলে এদের আগমন লক্ষ করা যায়।
আমাদের দেশে মোট পাখি আছে প্রায় ৬২৮ প্রজাতির। এর মধ্যে ২৪৪ প্রজাতির পাখিই স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বাস করে না। তারাই হচ্ছে এ দেশের অতিথি বা পরিযায়ী পাখি। শীতের শুরুতে এরা যেমন আমাদের দেশে আসে; তেমন শীতের প্রায় শেষের দিকে অর্থাৎ মার্চ-এপ্রিলে ওদের দেশে যখন বরফ গলতে শুরু করে, তখন তারা নিজেদের দেশে ফিরে যেতে শুরু করে। এই সামান্য কয়েক মাস সময়ের জন্য অতিথি হয়ে আমাদের দেশে এসেও তারা মুক্তি পায় না শিকারিদের হাত থেকে। কেউ শিকার করে বাজারে বিক্রি করে অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে আবার কেউ শিকার করে নিতান্তই শখের বশে। পাখিরা যখন নদীতীরে ঘুরে বেড়ায়, তখন তাদের শরীরে বিদ্যমান বাহারি রং রোদের আলো পড়ে চক চক করে। এ রকম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে অনেক ভ্রমণপ্রিয় মানুষ ভিড় জমায় সেখানে। আবার অনেকে তাদের শিকার করার জন্য প্রয়োজনীয় হাতিয়ার নিয়ে হাজির হয়ে যায়। ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী রক্ষা আইন ও ২০১২ সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে পাখি শিকার বা নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছরের কারাদন্ড ও এক লাখ টাকা নগদ জরিমানা। এই আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে প্রতিনিয়তই বেড়ে চলছে পাখি শিকার বা নিধনের পরিমাণ।
অর্থলোভী সুযোগ সন্ধানী একশ্রেণি সৌখিন ও পেশাদার পাখি শিকারিরা বন্দুক, বিষটোপ, কারেন্টজাল, বাঁশি বাজিয়ে, ছিটকা দিয়ে, রাত গভীর হলে ফাঁদ পাতাসহ নানা কৌশলে শিকার করা হচ্ছে অতিথি পাখি। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার ডুমুরিয়া, বাটিয়াঘাটা, দাকোপ, তালা, পাইকগাছা, ফকিরহাট, মোল্লাহাট, রূপসা, তেরখাদা, মোড়লগঞ্জ, কচুয়া, কয়রা এবং কালীগঞ্জ, কুশলিয়া, শ্যামনগর, আশাশুনি, তালাসহ বেশ কয়েকটি উপজেলায় পাখি শিকারির সংখ্যা বেশি। শিকার করা অতিথি পাখি বিক্রি হচ্ছে স্থানীয় বাজারেই। প্রতি জোড়া সাদা বক ২০০ থেকে ৩০০ টাকা, চখাচখি ১০০ থেকে ১২০, বালিহাঁস ৪০০ থেকে ৫০০, কাইয়ুম ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। পাখি শিকার করতে তেমন কোনো মূলধন লাগে না বিধায় অনেকে মাছ ধরা বাদ দিয়ে অবিরত শিকার করে যাচ্ছেন পাখি।
অতিথি পাখি শিকার বন্ধ করার জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে, যেসব এলাকায় অতিথি পাখিরা আসে, সেসব এলাকায় অতিথি পাখি নিধন সমন্ধে বিভিন্ন সভা করে; অতিথি পাখি শিকার বন্ধে বিভিন্ন প্রচারণা চালিয়ে, এলাকায় যারা অতিথি পাখি শিকার করে তাদের নামের তালিকা প্রস্তুত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে দিয়ে তাদেরকে সহযোগিতা করে। তার পাশাপাশি এসব পাখি শিকার বন্ধের জন্য পরিবেশবাদী সংগঠনকে শিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। শুধু রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারীর সচেতনতা নয়, সাধারণ জনগণকেও এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।
লেখক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
"