রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৯ জানুয়ারি, ২০১৮

বিশ্লেষণ

দুর্নীতি : শুধু অন্যায় নয়

সভ্যতার পতাকায় লেখা হলো, আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে, সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। গণতন্ত্রের নামে দেশে দেশে মানুষের মধ্যে সমবণ্টনেরও ব্যবস্থা করা হলো। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় সম্পদ কেউ একা ভোগ করতে পারবে না। সবারই এতে সমান অধিকার থাকবে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। নব্বই দশক পর্যন্ত মোটামুটি সবই ঠিক চলছিল। আমাদের মানবিক মূল্যবোধ মোটামুটি অক্ষুণœই ছিল। সব বিষয়ে দুর্নীতি এত রমরমা দেখা দেয়নি। সভ্যতার এতগুলো সোপান পেরিয়ে আজ শিক্ষিত বাংলাদেশি যেন সেখানেই ফিরে গেছে! প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতা খুললেই দেখা যায়, একশ্রেণির মানুষ জনগণের বরাদ্দ করা কোটি কোটি টাকা হাপিস করে দিচ্ছে। নিম্ন-দরিদ্র মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে এরা ব্যাংকে কোটি কোটি টাকার ভা-ার গড়ে তুলছে, নানা স্থানে একের পর এক গগনচুম্বী বিলাসবহুল অট্টালিকা নির্মাণ করছে। অন্যদিকে বহু মানুষ বাড়িঘরের অভাবে খোলা আকাশের নিচে গাছতলায় বাস করছে। প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? প্রবাদটির উৎপত্তি নাকি এই কারণে, প্রাচীনকালে সব ইঁদুর এক সভায় মিলিত হয়েছিল। ওই সভায় আলোচ্য বিষয় ছিল, বিড়ালের কবল থেকে ইঁদুর সম্প্রদায়কে রক্ষা করা। বিড়াল ওই সময় নির্বিবাদে ইঁদুর নিধন করতে শুরু করে, তাই সেই সময়কার সব ইঁদুর সভায় বসে সিদ্ধান্ত নেয়, বিড়ালের গলায় একটি ঘণ্টা বেঁধে দেওয়ার। আর এই ঘণ্টা বাঁধা হলে বিড়ালের আগমনে ঢং ঢং শব্দ হবে আর এই শব্দ শুনে সব ইঁদুর প্রাণ নিয়ে পালাতে পারবে। বিপত্তিটা হলো কোন ইঁদুর যাবে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধতে, যে যাবে তাকেই তো বিড়ালের পেটে চলে যেতে হবে। তাই বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কোনো ইঁদুরই পাওয়া গেল না।

দেশের দুর্নীতি নির্মূলের বিষয়টাও অনেকটা বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার মতো অবস্থা। কারণ যারা দুর্নীতিবাজ তাদের নেপথ্য হাত বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত। আর এই কারণে দুর্নীতিবাজদের নির্মূলে কার্যকর বা দৃশ্যমান পদক্ষেপ তেমন একটা দেখা যায় না। আরেকটা বিষয় খুবই লক্ষণীয়, তাহলো কিছু এনজিও এবং কথিত সিভিল সোসাইটি প্রতিনিয়ত দুর্নীতি নির্মূলে সভা-সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করেই চলেছে। কিন্তু কে এই দুর্নীতিবাজদের ধরবে তার সুনির্দিষ্ট রূপরেখা নেইÑএমনকি এমন কিছু এনজিও বিদেশি সাহায্য এনে এ ধরনের সেমিনার করে থাকে, তাদের কর্মকা- বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তাদের ভেতরেই রয়েছে দুর্নীতির আখড়া। সুতরাং এখানে বিষয়টি অনেকটা শর্ষের মধ্যে ভূতের মতো অবস্থা। দেশে নানা বিষয়ের দুর্নীতির শিকড় বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আছে। প্রযুক্তির উদ্ভাবনের ফলে দুর্নীতির ধরন গড়ন এবং পদ্ধতিতেই পেয়েছে বহুমাত্রিকতা। যেমন : একসময় দুর্নীতির মূল বিষয় ছিল ঘুষ আর এই ঘুষদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে বিনিময় হতো নগদ টাকায়। এই ঘুষ দেওয়া-নেওয়ার ধরনও পাল্টেছে, যেমন : এই টাকা নগদে না দিয়ে দেওয়া-নেওয়া হচ্ছে ফ্লেক্সিলোড, বিকাশ, এটিএম বুথের মানিট্রাকের, ক্রেডিট কার্ডসহ নানা আধুনিক পদ্ধতিতে। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এই বর্ধিত জনসংখ্যার সেবার, নিরাপত্তাসহ নানা নাগরিক পরিষেবা দিতে বেড়েছে অনেক সরকারি দফতর। দফতর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে দুর্নীতি। এই সম্প্রসারিত দুর্নীতি দমন করতে সরকার সংশ্লিষ্ট দুর্নীতির নির্মূল দফতরের কতটা প্রসারণ ঘটেছে তা দেখার বিষয়। দেশের দুর্নীতি নিরসন করতে কাজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন যার আগের নাম ছিল দুর্নীতি দমন ব্যুরো। এই দুর্নীতি দমন ব্যুরোর অভিযাত্রা শুরু ব্রিটিশ শাসনমালে ১৯৪৩ সালে। ২০০৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এই সংস্থাটির নামকরণ করা হয় দুর্নীতি দমন কমিশন।

সময়ের চক্রাবর্তে দুর্নীতির পরিমাণ যে হারে বাড়ছে দুর্নীতি দমনের জনবল সে হারে বাড়েনি। এখনো প্রতিটি জেলা সদরের দুর্নীতি দমন কমিশনের পূর্ণাঙ্গ অফিস নেই। বৃহত্তর ১৯টি জেলা সদরের অবস্থিত অফিস থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মীরা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এই কমিশনের জনবল কাঠামো অন্য যেকোনো দফতরের চেয়ে অনেকটা ভিন্ন। স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিলেও এই দুদক দুর্নীতির সব ক্ষেত্র নিরসনে পদক্ষেপ নিতে পারবে না তার কারণ জনবল এবং দফতর অপ্রতুলতা। প্রশাসনিকভাবে দুদকের কর্মরতদের পদবি অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পদবির মতো এক নামের হলেও গ্রেডগত কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। বাংলাদেশের সরকারি কর্মীদের এক ধরনের ইগোর সমস্যা থাকে। কার গ্রেড কার চেয়ে বড় এই নিয়ে। দেখা যায় একজন উচ্চ গ্রেডের কর্মকর্তার দুর্নীতিকে দুদকে কর্মরত তার চেয়ে একটু নিচু গ্রেড পদমর্যাদার কর্মী যখন প্রাথমিকভাবে কিছু জানতে চায় তখন তাদের মধ্যে সেই ইগো প্রবলেমটা দানা বাঁধে। সরকারি কর্মীদের ইগোর প্রবলেমটা সম্প্রতি সিভিল সার্জন এবং এডিসির হাতাহাতি থেকে বোঝা যায় যে তা কতটা ভয়াবহ। দেশের দুর্নীতি নিরসন করতে হলে দুদককে আরো শক্তিশালী করা দরকার। দুদককেও সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। সব স্তরের কর্মী নিয়োগসহ সব কর্মকা- বিচার বিভাগের মতো দুদক পরিচালিত করলে এই কমিশন আরো শক্তিশালী হবে।

আজকের দিনের শিক্ষাব্যবস্থায় মূল্যবোধযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার কোনো বালাই নেই। দিকে দিকে দুর্নীতির জোয়ার আটকাতে হলে ফের ওই মানুষ গড়ার শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। চরিত্র গঠন ও নীতিশিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। আর তা করতে হলে ধর্মীয় শিক্ষার বিকল্প নেই। গোড়াতেই অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের দুর্নীতি না করার জন্য শিক্ষা দেবেন। সদা সত্য কথা বলতে শেখাবেন। এটা করতে হবে সেই মন্ত্রে ‘আপনি আচরি ধর্ম পরের শেখাও।’ সন্তানদের সামনে অনেক অভিভাবকই মিথ্যা কথা বলে থাকেন। শিশুরা এটা শেখে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, কোনো এক পাওনাদার বাড়িতে এসে হাঁক দিল, ‘নরেন বাড়ি আছো কি? নরেনবাবু তার ছোট ছেলেকে কানে কানে বলে দিল বলে দে বাবা ঘরে নেই! এ থেকে ছেলে কী শিক্ষা পেল? ওই ছেলে বড় হলে একদিন ইঞ্জিনিয়ার বা আধিকারিক হয়ে কটা সত্য কথা বলবে? একশো বস্তা সিমেন্ট দিয়ে কোনো সেতু নির্মাণ করিয়ে দিয়ে এক হাজার বস্তা ব্যয় হয়েছে বলেই হিসাবটা সরকারের কাছে দাখিল করে দেবে। আজকের দিনে এদের সবার ক্ষেত্রেই তো ওই কথাটি সমান প্রযোজ্য। আজকের দিনের জনপ্রতিনিধি ও মস্ত্রীরাও তো ঠিক তা-ই। তাই তো দুর্নীতির রমরমা দেখা দিয়েছে। শেষ কথা হলো, আমাদের প্রত্যেককেই লোভ সামলাতে হবে। ইউরোপীয় ভোগবাদের প্রবল মোহ ছেড়ে দিয়ে আমাদের মূলমন্ত্র বৈরাগ্যের স্বর্ণখনিতে ফিরে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভোগে সুখ নেই, ত্যাগেই সুখ। এই ভোগবাদই ঘুষবাদের জন্ম দিয়েছে। আমার যা আছে তাতেই আমাকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এই সন্তোষই সুখের মূল। দুর্নীতি নির্মূল করার মাধ্যমে দেশ গড়তে হলে প্রথমত মূল্যবোধযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। দ্বিতীয়ত, অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের দুর্নীতি না করার জন্য শিক্ষা দিতে হবে। তৃতীয়ত, প্রত্যেককেই লোভ সামলাতে হবে। এভাবে এই তিনটি সূত্র প্রয়োগের মাধ্যমে ও শক্তিশালী আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি মহান দেশ হিসেবে গড়ে তোলা যাবে।

লেখক : বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist