অলোক আচার্য্য

  ১৮ জানুয়ারি, ২০১৮

শিক্ষক

সমাজ পরিবর্তনের কারিগর

জাতি বিনির্মাণের কারিগর। গুণাবলি বা দায়িত্ব দেখলে শিক্ষকদের অতিমানব বলেই মনে হয়। বাস্তবিকই তারা অতিমানব। এত এত গুণের সমাবেশ ঘটাতে হয় যে একজন অতিমানবেরও বুঝি এত ক্ষমতা থাকে না। সে জন্য শিক্ষকতাকে পেশা না বলে সেবা বলা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শিক্ষকদের বা এই অতিমানবদের অবস্থা দেশে খুব একটা সুবিধার নয়। গত বছরের শেষ থেকে শুরু করে চলতি বছরেও বিভিন্ন স্তরের শিক্ষক আন্দোলন হচ্ছে। নানা দাবি-দাওয়াতে তারা প্রচ- শীতে, মশার কামড়ে অসুস্থ হয়ে আমরণ অনশন করছে। অনেকে দাবি পূরণের আশ্বাসে ঘরে ফিরেছে। সর্বশেষ ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকরা কঠোর আন্দোলন করছেন। তীব্র শীতে তাদের কষ্টটা অনুভব করা যায়। দায়িত্ব সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলেও আমাদের দেশের শিক্ষকরা তাদের ন্যায্য প্রাপ্য পান না। যদিও বর্তমান সরকার শিক্ষকদের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। একের পর এক দাবি পূরণ করে তার প্রমাণ দিয়েছে। হাজার হাজার রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের মতো বড় কাজ এই সরকারের সময়েই সম্ভব হয়েছে। কিন্তু তার পরও শিক্ষকদের আজও অবহেলার শিকার হতে হচ্ছে। যারা প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা তৈরি করেন তাদের বড় অংশই আজও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী।

শিক্ষক কে? শিক্ষকের সংজ্ঞা কী? একজন শিক্ষক কতটুকু করতে পারেন। বর্তমান সময়ে শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবিষয়ক আলোচনা হয় প্রচুর। একজন শিক্ষক কেমন হবেন? এসব বিষয় নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। সেসব গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে একজন শিক্ষকের দায়িত্ব ও গুণাবলি। খুব সাধারণভাবে বোঝালে যিনি তোমাকে একদিনের জন্যও কোনো বিষয়ের শিক্ষা প্রদান করেছেন তিনিই শিক্ষক। শিক্ষক, শিক্ষা ও শিক্ষার্থী শব্দগুলো পারস্পরিক নির্ভরশীল ও একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। শিক্ষকবিহীন শিক্ষা যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনি শিক্ষার্থীবিহীন শিক্ষাও অর্থহীন। শিক্ষক তার কাছে আসা শিক্ষার্থীদের জীবনে বেঁচে থাকার, জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার মন্ত্র শিখিয়ে দেন। তিনি শিক্ষার্থীদের মনের আবেগ নিয়ন্ত্রণের দীক্ষা দেন। তিনি চান যেন তার শিক্ষার্থী জীবনের সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে বিজয়ী হোক। আবার একজন শিক্ষককে বলা হয় আজীবন ছাত্র। জ্ঞান অন্বেষণে তার তৃষ্ণা অপরিসীম। নিজে না শিখলে অন্যকে কী শেখাবেন। তাই তো তাকে পড়তে হয়, জানতে হয় এবং জানাতে হয়। এই জানানোর কাজটি হচ্ছে শিক্ষকতার জীবনের সব থেকে পরিশ্রমী এবং কঠিন কাজ। কারণ তার জানানোর কাজটি সফল হয়েছে কি না তা বুঝতে পারাও একটি বড় দক্ষতার ব্যাপার। একজন শিক্ষক হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যার মধ্যে পরামর্শক হওয়ার, শিক্ষা-সহায়ক ব্যক্তি, শিক্ষক নিজেই শিক্ষা-সহায়ক সামগ্রীর উন্নয়ন করবেন, তার আচরণ হবে রোল মডেল, তিনি সমাজের দর্পণ, কারিকুলাম প্রস্তুতকারক, শিক্ষা সংগঠক এবং নির্দেশক ইত্যাদি গুণাবলি সম্পূর্ণ মানুষ। সত্যি কথা বলতে একদিক থেকে শিক্ষক একজন সত্যিকারের অতিমানব যাদের থাকে সহজেই আকৃষ্ট করার ক্ষমতা। আবার একদিক থেকে শিক্ষকরা খুব সাধারণ একজন মানুষ যারা তৈরি করে অসাধারণ সব মানুষ। শিক্ষা কোনো পেশা নয় বরং একটি সেবা। সমাজে অনেক সেবামূলক কাজ রয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। শিক্ষা হচ্ছে একটি ব্রত। যে ব্রত দিয়ে তিনি তার ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটান। শিক্ষকের এই কাজটির সফলতা ও ব্যর্থতার মধ্যে রয়েছে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ।

শিক্ষক নিয়ে ছোটবেলায় বাদশা আলমগীরের কবিতা পড়েছি। এই কবিতা আমরা সবাই পড়েছি। আমার খুব ভালো লাগত। শিক্ষকের মর্যাদা দেওয়ার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই কবিতা। পড়েছি এবং শিক্ষকদের নিয়ে কল্পনায় অন্য ধরনের উচ্চতায় চিন্তা করেছি। একজন বাদশা হয়ে যিনি শিক্ষকের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল এবং শিক্ষকের প্রতি সন্তানের একটু অবহেলাও তিনি মেনে নিতে পারেননি। শিক্ষকের চিন্তাতেও যখন ওই অবহেলার বিষয়টি ছিল না তখন বাদশা তাকে বিষয়টি বলেন। তার যে এ বিষয়টাও সন্তানের শিক্ষার মধ্যে আনা উচিত ছিল তা বোঝানোর জন্যই তিনি শিক্ষককে ডেকেছিলেন। আর তাই বাদশা আলমগীরকে কবিতায় মহান বলে বর্ণনা করা হয়েছে। যিনি সত্যই বুঝেছিলেন শিক্ষকের মর্যাদা কেমন হওয়া উচিত। বছরের পর বছর পাস করিয়ে রেজাল্ট ভালো করাতে পারলেই কিন্তু শিক্ষকের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বরং দায়িত্ব তো প্রতিটি শিক্ষার্থীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটানো। একজন শিক্ষকই যা আবিষ্কার করতে পারেন এবং তা ব্যবহারে পথ দেখাতে পারেন। তবে বর্তমানে গুটিকয়েক শিক্ষকের কর্মকা-ে প্রায়ই এ পেশা সমালোচিত হয়। কিন্তু গুটিকয়েক উদাহরণ থেকে সার্বিক মূল্যায়ন করাটা বোকামি। শুধু পেশায় নিয়োজিত হলেই শিক্ষক হওয়া যায় না। শিক্ষক হতে হলে তার সম্পর্কিত গুণাবলি অর্জন করতে হবে। শুধু পোশাকে বা পেশায় শিক্ষক হয়ে কী লাভ? বাবা-মা যেমন সন্তানের বুকের ভেতর বেঁচে থাকে, ঠিক তেমনি করেই শিক্ষক বেঁচে থাকেন তার শিক্ষার্থীর মধ্যে।

শিক্ষক হিসেবে একজন মানুষ কখন সফল তা নির্ণয় করা তার চাকরির বয়সের ওপর নির্ভর করে না। বরং সেই শিক্ষক কতজন শিক্ষার্থীর ভেতর নিজের আদর্শ প্রভাবিত করতে পারছেন, কতজনকে মানুষ হওয়ার সঠিক পথ দেখাতে পেরেছেন তার ওপর নির্ভর করে। শিক্ষক বেঁচে থাকেন শিক্ষার্থীর মধ্যে। মানুষ হওয়ার সেই মন্ত্র একমাত্র শিক্ষকের ভেতরেই থাকে। একজন শিক্ষার্থী শিক্ষক সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করার সুযোগই পাওয়া উচিত না। কারণ যে প্রকৃত শিক্ষক সে কোনো দিন কোনো একজন শিক্ষার্থীর জীবনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এমন কিছু করেন না। শিক্ষকতা পেশায় থাকলেই কি প্রকৃত শিক্ষক হওয়া যায়। এটাও এক ধরনের প্রাণান্ত চেষ্টার ফল। অযোগ্য অপদার্থ মস্তিষ্ক বিকৃতি মানুষরা তাই চাকরি করলেও শিক্ষক হওয়ার যোগ্যই তারা নন।

সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী গুটিকয়েক অসাধু শিক্ষকের প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত বলে উল্লেখ করেছেন। শিক্ষকরা নাকি পরীক্ষার দিন সকালে খাম খুলে প্রশ্ন ফাঁস করে। প্রশ্ন হলো এই পাবলিক পরীক্ষার দিন শিক্ষকরা এই সুযোগটা পায় কখন? শিক্ষকদের ওপর দায় চাপিয়ে প্রশ্ন ফাঁস নামক রোগ থেকে উত্তরণ পাওয়া অসম্ভব। শিক্ষকদের একটা অংশ জড়িত এ কথা সত্যি কিন্তু বারবার কেবল শিক্ষকদের দিকে ইঙ্গিত করলে বাকিরা আড়ালে থেকে যাবে। দুদকের প্রতিবেদনে প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের কথাও এসেছে। এমনকি বেসরকারি টেলিভিশনের প্রতিবেদন এবং এর ধারাবাহিকতায় যারা গ্রেফতার হলো সেখানেও কিন্তু ক্রীড়া কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। আর পরীক্ষার দিন সকালে যদি খাম খুলে প্রশ্ন ফাঁস হয় তাহলে পরীক্ষার আগের রাতে ফেসবুকে যে প্রশ্ন পাওয়া যায় এবং পরের পরীক্ষায় মিলে যাওয়ার খবর আসে সেগুলো কীভাবে সম্ভব হয়? শিক্ষকদের একটি চক্র এই প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত এ কথা অস্বীকার না করে বলা যায়, একতরফা কেবল শিক্ষকদেরই দোষ দেওয়া যায় না।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist