জি. কে. সাদিক
মতামত
দুটি ভ্রমণ ও একটি বিশ্লেষণ
গত বছর ২০ ডিসেম্বর আমার এক বন্ধুর বাবা মারা যান। ঝিনাইদহের শৈলকূপা থানার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের দেবীনগরে বন্ধুর বাড়ি। বন্ধুর বাবার জানাজায় অংশগ্রহণের জন্য যাই। যাত্রপথের বাড়তি প্যাঁচালে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না। বর্তমানের বাংলাদেশের সড়কপথের অবস্থা সবার জানা। সে গল্প করতে গেলে মায়ের কাছে মাসির গল্প বলা হবে। দুপুরের পর গন্তব্যে পৌঁছাই। গোটা গ্রামটা দেখে মনে হলো, আমি কোনো বাস্তুহারা বস্তি এলাকায় এসেছি। গ্রামের প্রায় মানুষের নিবাস বলতে মাটির ছোট কুঁড়েঘর। মানুষজন শিক্ষার আলো থেকে যথেষ্ট দূরে। মানুষগুলো দেখে মনে হলো গল্পের বইয়ে যে প্রাচীন গ্রামবাংলার রূপকল্প বর্ণিত হয়েছে তার বাস্তব দেখছি। দুপায়ে মাটির রাস্তায় গ্রামের চলার পথ। গ্রামের ভেতরের রাস্তা দেখে মনে হলো আমি আফ্রিকার কোনো গ্রামে এসেছি। যেমনটা মাঝেমধ্যে ডিসকভারি চ্যানেলে দেখি। আমরা যে একটা উন্নয়নশীল দেশের মানুষ, যে দেশের জিডিপি ৭.২৮ শতাংশ, প্রত্যেকের মাথাপিছু আয় ১৬১০ মার্কিন ডলার, ২০২১ সালের মধ্যে আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের গ-ি টপকে মধ্যম আয়ের দেশের সারিতে পৌঁছাব এই কথাগুলো আমি মেনে নেওয়া তো দূরে থাক, মনেও করতে পারছিলাম না। এখনো সভ্য দুনিয়ার একটুকরো এই গ্রামের মানুষ গাঁজার চাষ করে। হাত বাড়াতেই গাঁজা, হেরোইন, আপডেট মাদক ইয়াবাসহ প্রায় সব ধরনের মাদক পাওয়া যায়। ভাগ্যের জোরে বিধির লিখন খ-াতে না পেরে অনেকে মেট্রিকের (এসএসসি) গ-ি পেরিয়ে আইএ (এইচএসসি) পর্যন্ত মাড়িয়ে পড়ালেখা ইস্তফা দিয়েছে। বন্ধুর মুখখানার দিকে তাকিয়ে সেদিন করুণা বা দয়ার উদ্বেগ হয়নি, আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। কী করে সে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এসেছে। বন্ধুকে ভিন গ্রহের মানব মনে হলো। এই হলো আমাদের অর্জন, যা আমরা স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরে বুক উঁচু করে আমাদের জনসেবকদের বলতে দেখি। ভোটের মিছিলে জনতার ফিরিস্তি আর ফটকাবাজ নেতাদের উন্নয়নের খেস্তিখেউর শুনে মাঝেমধ্যে মনে কয় আহ! যদি পারতাম নেতাকে একবার আমার এলাকার যুদ্ধবিধ্বস্তের মতো রাস্তায় ভ্যানে চড়িয়ে ঘুরিয়ে আনতাম। তাহলে নেতার আর দেশ চালানো লাগত না, মাজার চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর বা উন্নত দেশে চলে যেতে হতো।
দ্বিতীয় যে ভ্রমণের গল্প সেটা নতুন বছরের ৯ জানুয়ারির কথা। আমি একেবারে ‘না হলেই নয়’ এমন প্রয়োজন ছাড়া ক্যাম্পাস ছেড়ে কুষ্টিয়া শহরে যাওয়ার দুঃসাহস দেখাই না। তবু ‘প্রয়োজন কোনো নিষেধ মানে না’ তাই মনের জোর হিমালয়সম করে স্রষ্টার নাম জপতে জপতে বের হই। কুষ্টিয়া অঞ্চলের কোনো পাঠক যদি আমার লেখাটা পড়ে তাহলে পাঠকের মাথাটা নিজের অজান্তেই ‘হ্যাঁ’-সূচক মনৌসম্মতিতে দুলে উঠবে বা যারা এ অঞ্চলে এসেছেন তারাও সত্যতার জীবন্ত প্রমাণ। ৯ জানুয়ারি কুষ্টিয়ার মজমপুর গেট পার হওয়ার পর গাড়ি একবার ডানে আবার বামে কাত হতে হতে চলছে। আর একটু পরপর মনে হলো গাড়িটা বিশাল উঁচু-উচু ‘স্পিড ব্রেকার’ পার হচ্ছে। দুচোখ মেলে যা দেখলাম তাতে আমার পশ্চিমা সাংবাদিক ইভান রিডলির লেখা ‘ইন দ্য হেন্ড অব তালেবান’ বইটার কথা মনে পড়ে গেল। ইভান সে বইতে আফগানিস্তানের যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকার রাস্তার কথা বলেছে। যখন তাকে পাকিস্তান সীমান্ত থেকে ধরে রাজধানী কাবুলে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন কাবুলগামী রাস্তায় পাথরের গাঁথুনি থেকে পাথর উঠে গিয়ে অন্যত্র উল্টে পড়ে আছে। তার ওপর দিয়ে গাড়ি চালার সময় মনে হচ্ছিল কখন যেন গাড়িটা সড়ক থেকে নিচে উল্টে পড়ে। আর মাজার প্রত্যেকটা হাড় তার শেষ অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করছিল। ইভানের বই পড়ার সময় মনে যে চিত্রকল্পা ভেসে উঠেছিল, আমি তার বাস্তব দেখছি মনে হচ্ছে। শুধু পার্থক্য এটাই যে সেটা আফগানিস্তান; সোভিয়েত রাশিয়া আর মার্কিন বোমাবর্ষণ ক্ষেত্র। আর এটা আমার স্বপ্নের সোনার বাংলা যেটা দুর্নীতিবাজ, মিথ্যুক, টাউট-বাটপার প্রজাতির নেতা প্রজনন কেন্দ্র। অবশ্য সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য নয়।
এদিকে রাজধানী আর জেলা শহরগুলোর প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে নেতার উন্নয়নের গলা ফাটা ফিরিস্তি চলে। জনবিচ্ছিন্ন এই উন্নয়নের রূপকারদের জন্য সংসদে একটা বাধ্যতামূলক আইন করা দরকার, নেতাকে মাসে অন্তত একবার নিজ এলাকায় খালি ভ্যানে করে, কিছু পায়ে হেঁটে ঘুরে আসতে হবে। মাঝেমঝেধ্য বাসে করে গ্রামের বাড়ি যেতে হবে। স্টেশনে দাঁড়িয়ে ট্রেন ধরতে হবে। হাসপাতালে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে ডাক্তার দেখাতে হবে। প্রাসাদ ছেড়ে মাসখানেক সাধারণ মানুষের মতো ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকতে হবে। তাহলে অন্তত নেতার উন্নয়নের গাল খেঁচা থেকে জাতি রেহায় পেত, প্রকৃত উন্নয়নের দেখা পেত। জননেতা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। আমরা যেমন আজব জনতা তেমনি আমাদের নেতা। তা না হলে একই মুদ্রার পিঠ বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখি?
‘ভোটের সময় বোঝাবো’Ñএই হলো আমাদের জনগণের মাজার সর্বশেষ জোর। কিন্তু ভোটের সময় এক প্যাকেটবিড়ি বা সিগারেট, তিন কৌটা ঈগল মার্কা গুলে নেশায় সমস্ত জোর নিঃশেষে বিভাজ্য হয়ে আবার কপাল ফাটার মতো ফটিকচাঁদ মার্কা নেতাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিই। বলতে হবে আমাদের নেতারা হলো পৃথিবীর সেরা ‘মোটিভেটিভ স্পিকার’। জনসভায় বক্তব্য দিয়ে আর সাধারণ জনগণের মাথায় হাত বুলিয়ে কেমন করে আবার ক্ষমতায় আসে সেটা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। আমার কাছ থেকে যে ক্ষমতা নিয়েছে কাল সে ক্ষমতা আমার ওপর খাটিয়ে আমার ট্যাক্সের টাকা বিদেশে পাচার করবে। গ্রামের বয়স্ক ভাতার টাকা, ফকির-মিসকিনের জন্য সরকারি ত্রাণের টাকা মেরে নেতার বিলাসবহুল গাড়ি আর করবিহীন গাড়ি হয়। মসজিদ-মন্দির-গির্জার টাকা মেরে খেতেও এই নেতারা খড়গহস্ত। নেতার ছেলে যায় লন্ডন পড়তে আর আমার ছেলে নেতাদের সংসদে পাস করা মাসিক ৬০০ টাকার বৃত্তি পেয়ে গ্রামের গুরুহীন বিদ্যালয়ে পড়ে। এই না আমাদের দেশের জননেতা আর জনতার সম্পর্ক? জনতার টাকায় সরকারি হাসপাতালে নেতা পায় ‘স্পেশাল’ চিকিৎসা। আর হতভাগা জনতা হাসপাতালে বারান্দায় কাতরায় আর জীবন দেয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
"