রায়হান আহমেদ তপাদার
বিশ্লেষণ
কোথায় সভ্যতা
বিশ্বজুড়ে আজ মানুষ মরছে পাখির মতো। নির্যাতিত আর উৎপীড়িতের হাহাকারে যেন ফেটে পড়তে চাইছে আকাশ-বাতাস। সবচেয়ে মর্মান্তিক অবস্থা মুসলিম জনগোষ্ঠীর। বোধকরি, এ কারণেই একটু বেশি নিশ্চুপ পুরো বিশ্ব। নির্বিকার জাতিসঙ্ঘ, নির্লিপ্ত পরাশক্তি। ভাবটা এমন, মুসলমানদের কোনো দেশ থাকতে নেই। তারা থাকবে অন্যের অধীনে অনেকটা উদ্বাস্তু হয়ে। যাযাবরের মতো ঘুরবে দেশে দেশে আর মার খাবে পড়ে পড়ে; কিন্তু বলতে পারবে না কিছুই। মানবতা আর নিরপেক্ষতার বর্তমান এই দুরবস্থার জন্য দায়ী মানুষ নিজেই। সব ডাকাতেরই লক্ষ্য থাকে লুটপাটের দিকে, খুনির থাকে রক্তের নেশা। এরা নিষ্পাপ ফুলকেও পিষে মারতে পারে নির্দ্বিধায়, তাদের জন্য সেটাই স্বাভাবিক। তাই ফুল রক্ষা তাদের কাজ নয়। চাই সুন্দর মনের মানুষ, যারা বোঝে সৌন্দর্য। তেমন চেতনার অধিকারী হতে পারে শুধু শক্ত ইমানের প্রকৃত মুসলমানরাই, অন্য কেউ নয়। সভ্যতার ইতিহাস সে কথাই বলে। কিছুকাল আগেও বিশ্ব ছিল ব্যাপকভাবে মুসলিমশাসিত, মূলত মুসলিম দর্শনে দীক্ষিত। সেই দীক্ষায় নীতিনৈতিকতা বিকিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না কখনো।
মুসলমানরা রক্ষা করে থাকে অন্যের ধর্মকেও। কারণ, তেমন কার্যকর ধর্মনিরপেক্ষতার কথাই বলেন বিশ্বস্রষ্টা মহান আল্লাহ পাক, যা কিনা ইসলামী আদর্শ ও দর্শনের অন্যতম ভিত্তি। অতি কঠোর ভাষায় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে অন্যের ধর্মকে সম্মান করতে, ভিন্নধর্মীদের সুরক্ষা দিতে। এটি প্রতিটি মুসলমানের জন্য অবশ্যই কর্তব্য। শুধু বক্তৃতাবাজি করে, মুখে সুন্দর কথার খৈ ফুটিয়ে আর কোরাস গেয়ে সেই দায়িত্ব শেষ করার কোনো শর্টকাট রাস্তা নেই মুসলমানদের জন্য। প্রতিটি মুসলমান তার কাজকর্ম এমনকি কথাবার্তার জন্যও আল্লাহপাকের কাছে দায়বদ্ধ। এমন কঠিন ধরপাকড়ের ব্যবস্থা ছাড়া শুধুই মুখের বুলিতে দুনিয়াকে ধর্মনিরপেক্ষ করার ভাবনা নিতান্তই কল্পনাবিলাস মাত্র। আর তাই প্রকৃত মুসলিম শাসন ছাড়া অন্য কোনোভাবেই সম্ভব নয় বিশ্বের বুকে সব ধর্মের অধিকার নিশ্চিত করা। নির্মম এই মুসলিম নির্যাতনকে বিধিসম্মত করা হচ্ছে অতি চাতুর্যের সঙ্গে। এ জন্য মুসলমানদের বানানো হচ্ছে সন্ত্রাসী। বর্বর প্রমাণ করতে তাদের নামে সুকৌশলে সৃষ্টি করা হচ্ছে বিভিন্ন উগ্র সংগঠন। এরা মুসলিম নামধারী, কিন্তু তাদের অর্থ ও অস্ত্রের উৎস ধূর্ত বিধর্মীরা। এদের দিয়েই বোমাবাজি ও সন্ত্রাস করিয়ে দায় চাপানো হচ্ছে পুরো মুসলিম জাতির ওপর। এসবই এখন ওপেন সিক্রেট। এগুলো সুগভীর কোনো ষড়যন্ত্র চক্রের কারসাজি ছাড়া আর কিছু নয়। শুরুর দিকে রক্তাক্ত এই দমন-নিপীড়নের ক্ষেত্র ছিল মূলত ফিলিস্তিন আর কাশ্মীর। সেই সাফল্যে উজ্জীবিত হয়েই বোধকরি মুসলিম নিধনক্রিয়া এখন প্রসারিত বিশ্বব্যাপী। এরই ধারাবাহিকতায় এখন নিয়মিত বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন মুসলমানরা।
উল্লেখ্য, ইরাক, আফগান, লিবিয়া, সিরিয়া এবং ইয়েমেনের মুসলমানরা আজ সর্বস্বান্ত। তার সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে পুরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এসব যেন তেমন কিছুই না। মুসলমান মরলে যেন কিছুই যায়-আসে না। এদের যেন মরাই উচিত। মুসলমান হয়ে জন্মানোটাই যেন এদের আজন্ম পাপ। বাংলাদেশের অভ্যুদয়েও ঘটেছে একই ঘটনা, বসনিয়াতেও হয়েছে তা-ই। বিবিধ অজুহাতে মুসলমানদের রক্তক্ষয় আর সঙ্ঘাতকে উসকে দেওয়া হয়েছে বারবার, এখনো হচ্ছে এবং তা দীর্ঘায়িতও করা হচ্ছে নিপুণ কৌশলে। রুয়ান্ডাও রক্তাক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়েই। মুসলিম দেশ না হয়েও তাকে পোহাতে হয়েছে অবিশ্বাস্য ভোগান্তি। মাত্র তিন মাসে সেখানে ১০ লাখ লোককে জবাই করে পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে; কিন্তু নড়েনি জাতিসঙ্ঘ। তাকে নড়তে দেয়নি বিশ্ব মুরব্বিরা। কারণ সেখানে তাদের কারোরই কোনো স্বার্থ ছিল না। অনর্থক সম্পদ খোয়াতে কেউই রাজি হয়নি। এসব প্রমাণ করে যে, বিশ্বসঙ্ঘ আসলে একটা জি হুজুর সংস্থা মাত্র। বিশ্ব মস্তানদের তল্পীবহনই তার জন্মগত আদর্শ ও দর্শন। তার মূল কাজ হলো এসি ঘরে বসে জগতের তামাসা দেখা আর প্রভুরা যা বলে তাতেই জি জাঁহাপনা বলা।
‘জনগণই ক্ষমতার উৎস’ সেøাগানের আড়ালে আমজনতাকে প্রতারিত করা হচ্ছে দেশে দেশে, প্রকাশ্যে। জনতার দোহাই দিয়ে পর্দার আড়ালে হচ্ছে ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা, ভোটের আগেই নিশ্চিত হচ্ছে নির্ধারিতদের গদি। আর নিরীহ জনগণকে তা দেখতে হচ্ছে নীরবে। সব জেনে-বুঝেও তারা বলতে পারছে না কিছুই, কারণ রসুনের গোড়ার মতো সব জালিয়াতের গোড়াও একই জায়গায়, জগতের মস্তানদের হাতে। জাতিসঙ্ঘের মতোই তাদেরও ক্ষমতার উৎস বিবিধ সব সাংবিধানিক ‘রাবার স্ট্যাম্প’, যা ব্যবহার করে দিনকে রাত বললেও সেটাই মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে সবাই। কারণ, সেটাই আইন। সেভাবেই লেখা হচ্ছে সংবিধান, সেভাবেই হচ্ছে আইনের ব্যাখ্যা। এমন ভোটাভুটির গণতন্ত্রই সাদ্দাম-গাদ্দাফিকে ক্ষমতায় রেখেছিল যুগের পর যুগ। ক্ষমতায় রেখেছিল হোসনি মোবারক আর রবার্ট মুগাবেদের। ক্ষমতায় রেখেছে সৌদি শাহানশাহকে। সেই তন্ত্রই চলছে জগৎজুড়ে। এই তন্ত্রের মূল কথাই হলো ‘ক্ষমতা আমার এবং শুধুই আমার’ তা ভোটের বাক্সে যা-ই থাকুক না কেন। ভোটার ছাড়াও বাক্স উপচে পড়ে এই তন্ত্রে। সামরিক একনায়কও এই ‘তন্ত্রে’র নায়কদের কাছে যেন নস্যি। এদেরও পার্লামেন্ট থাকে। ‘জি জাঁহাপনা’ বলে মুখ ফেনায়িত করাই সেই পার্লামেন্টের একমাত্র কাজ। সে রকম ‘অভিজ্ঞরাই’ শুধু হতে পারে সেই পার্লামেন্টের সদস্য। সেখানে এমনও ‘স্বরচিত সদস্য’ থাকতে পারে, যার নামও হয়তো দেশবাসী শোনেনি কোনোকালে। থাকতে পারে এমন ‘নরখাদক সদস্য’ও যার বংশ ঐতিহ্যই হয়তো মানুষের রক্ত পান। পরম পরিতাপ ও আতঙ্কের বিষয়, পদাধিকার বলে এরাই হচ্ছে দেশের আইনপ্রণেতা, দেশের হর্তাকর্তা।
অধিকন্তু এদের অধীনেই কাজ করতে হচ্ছে দেশের অতি প্রশিক্ষিত জাঁদরেল সব আমলা, শিক্ষক, আদালত আর সামরিক কর্তাকে। তারা বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত হিতৈষীদের অবদান থেকে। এ এক মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। এমন ‘গণতন্ত্র’ আসলে ‘মেষের পোশাক পরা নেকড়েতন্ত্র’ মাত্র। অথচ এদেরই লালন করে চলেছে আজকের জাতিসঙ্ঘ ও বিশ্ব গণতন্ত্রের মুরব্বিরা। ইচ্ছা করলেই এরা পারে এই নেকড়েদের রুখতে, সেই ক্ষমতাও তাদের পুরোপুরিই আছে। কিন্তু নেই শুধু ইমানের সততা, যা কি না অত্যাবশ্যক যেকোনো মহৎ কাজের জন্য। এ অবস্থায় অনেক পুরনো সংজ্ঞারই আশু পরিবর্তন আজ যেন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা ও মানবতার ধারণা পাল্টাতে শুরু করেছে এরই মধ্যে, সভ্যতাও চলতে শুরু করেছে উল্টো পথে। এমন কলুষিত শাসক ও শাসনব্যবস্থার সামান্য স্পর্শই যথেষ্ট পুরো জগৎসংসারকে অপবিত্র করার জন্য। এ কারণেই আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের শুরুতেই ‘সব মানুষ সমান লেখা থাকার পরও সেখানেই পদে পদে দেখা যাচ্ছে মর্মন্তুদ বৈষম্য। এদের টাকা-পয়সাজুড়ে ‘স্রষ্টার ওপর বিশ্বাসের কথাও লেখা আছে বড় হাতের হরফে কিন্তু তার চিহ্ন মাত্র দেখা যাচ্ছে না নেতাদের কাজকর্মে। বরং যে ধর্মগ্রন্থ হাতে তারা শপথ নিচ্ছেন, তার বিরোধিতাতেই শুরু করছেন দিন। কিন্তু এদের কাছ থেকে বস্তুত জগতের সহজতম সত্যটাও আশা করা বৃথা। কারণ এই ‘তন্ত্রে’ ক্ষমতাই মোক্ষ, তাই ভোট বাড়ানোর দিকেই থাকে লক্ষ্য, এমনকি তা সরল-সত্য পথ বিকিয়ে হলেও। এ জন্যই এদের হাতে পড়ে ধর্মনিরপেক্ষতার অনুপম বাণীও আজ কেঁদে ফিরছে পথেঘাটে। নিরপেক্ষতার নামে দুনিয়াজুড়ে চলছে চরম ধর্মহীন উন্মত্ততা। ভিত্তিহীন ধর্মের নামে মানুষের খাবার থালাকে পর্যন্ত সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে এখন। একের ধর্মীয় রীতিনীতি অন্যকে মানতে বাধ্য করা হচ্ছে শক্তি দিয়ে। এতে মানুষের অধিকারই শুধু দলিত হচ্ছে না, বরং নির্বিচারে জীবনও দিতে হচ্ছে তাদের। সেই জীবনটাও নেওয়া হচ্ছে পিটিয়ে মারার মতো ভয়াবহ বীভৎসতার সঙ্গে এবং তা করা হচ্ছে কথিত ধর্মেরই দোহাই দিয়ে। অথচ মুখে ফুটছে ধর্মনিরপেক্ষতার মহান বাণী। কি জঘন্য প্রতারণা, নির্লজ্জ মিথ্যাচার। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সভ্যতা হয়তোবা অন্য কোনো গ্রহে পালিয়ে গিয়ে নিজেকে রক্ষা করবে।
লেখক : বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
"