আবদুর রহমান

  ১৫ জানুয়ারি, ২০১৮

মতামত

জাতীয় স্বার্থেই জাতীয়করণ

শিক্ষা জাতীয়করণের এক দফা দাবি নিয়ে আবার আন্দোলনে নেমেছে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী সংগঠনসমূহ। তীব্র শীত ও কনকনে ঠা-ায় কুয়াশার চাদরে ঢাকায় খোলা আকাশের নিচে রাত কাটছে জাতি গড়ার কারিগরদের। এ লজ্জা আমার আপনার সমগ্র জাতির। হায় সেলুকাস! কী বিচিত্র এ দেশ। যে দেশে ন্যায্য অধিকারপ্রাপ্তিতে পাঠদান ছেড়ে শিক্ষকসমাজকে রাজপথে নামতে হয়। যে দেশে শিক্ষকদের বৈশাখী ভাতা না দিয়ে বাঙালিত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। ক্রমবর্ধিত দ্র্রব্যমূল্যের বাজারেও তাদের বঞ্চিত রাখা হয়েছে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট থেকে। সবাই বলে শিক্ষকের মর্যাদা নাকি সবার ওপরে। অথচ আমাদের দেশে শিক্ষকসমাজ আজ সবচেয়ে অবহেলিত আর তাদের রাখা হয়েছে অনুদানভুক্ত করে। শিক্ষা মানুষের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার। একটি দেশ ও জাতিকে যদি উন্নতির চরম শিখরে পেঁৗঁছাতে হয় তবে শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন অনস্বীকার্য। শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ইতিবাচক ও স্থায়ী আচরণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে শিশুকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। ক্রমবর্ধিত জনসংখ্যাকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার মাধ্যমও শিক্ষা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের দেশে শিক্ষা খাত-ই সবচেয়ে অবহেলিত আর শিক্ষকসমাজকে রাখা হয়েছে দয়ার দাস তুল্য করে। বর্তমান সরকার টানা ৯ বছর ধরে দেশ পরিচালনা করলেও দেশের সিংহ ভাগ শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনাকারী পাঁচ লাখ এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীর জীবন মান উন্নয়নে দৃশ্যত কোনো পদক্ষেপ তারা নেয়নি। দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসলেও মানুষ গড়ার কারিগরদের জীবন আটকে আছে ভাটার চরে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে শিক্ষা খাতকে অবহেলায় রেখে উন্নয়ন কখনো টেকসই হয় না। মধ্যম আয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও এসডিজি অর্জনে সরকার নানা মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। অথচ শিক্ষাব্যয় যে শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ তা তারা অনুধাবন করছেন না। এসডিজি অর্জনে জাতিসংঘ যে ১৭টি দফা দিয়েছে, তার অন্যতম হলো মানবসম্পদ উন্নয়ন। আর মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার হলো শিক্ষা। জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণার ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদের শিক্ষাকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমাদের সংবিধানের ১৫ ও ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদের শিক্ষা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। এখন প্রশ্ন হলো শিক্ষা খাতকে অবহেলায় রেখে কী এসডিজি অর্জন বা মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি মিলবে?

কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে চাইলে তার শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করলেই যথেষ্ট। বিখ্যাত ফরাসি যোদ্ধা নেপোলিয়ন বলেছিলেন, তোমরা আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি উপহার দেব। আবার দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন, শিক্ষা হলো সত্যের প্রকাশ আর মিথ্যার বিনাস। আমাদের দেশের সরকার কবে শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করবে কে জানে। যাই হোক আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে, উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছাতে ও সামাজিক-মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি গঠনে শিক্ষার যে বিকল্প নেই তা বলাবাহুল্য। এর আলোকে বিশ্বের উন্নত দেশ এমনকি পার্শ্বেবর্তী ভারতও তাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করেছে। কেননা শিক্ষাকে অবহেলায় রেখে কোনো জাতি বা দেশ বেশিদূর এগোতে পারে না। এমনিতেই বাংলাদেশ এশিয়ার ১২টি দেশের মধ্যে কম্বোডিয়া বাদে শিক্ষাব্যবস্থায় পিছিয়ে রয়েছে। মাধ্যমিকে আমাদের শিক্ষার হার ৬৩ শতাংশ আর বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষায় মাত্র ১৩ শতাংশ। তাই শিক্ষা খাতকে এগোতে হলে জাতীয়করণ করে সবার আগে শিক্ষকসমাজের জীবন মান উন্নয়ন প্রণিধানযোগ্য। কেননা পেটে ক্ষুধা আর আর্থিক দৈন্যতা নিয়ে ভালো পাঠদান অসম্ভব। পাশাপাশি সময়োপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষকদের করতে হবে প্রশিক্ষিত।

জাতীয় উন্নয়নের মূল শক্তিই হলো শিক্ষা। শিক্ষা কাঠামো সমাজ বা রাষ্ট্রের দর্পণস্বরূপ। আর শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমেই প্রতিফলিত হয় জাতির আশা-আকাক্সক্ষা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনপ্রবাহ। সরকারের ডিজিটাল আর মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন কি শিক্ষা খাতকে অবহেলায় রেখে অর্জিত হবে? সুনাগরিক ও শিক্ষিত জাতি গঠনে শিক্ষার বিকল্প নেই। জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করার মাধ্যমও শিক্ষা। জাতীয় অগ্রগতি ও উন্নয়ন নিশ্চিতে প্রাথমিক শিক্ষার মতো পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ সময়ের দাবি। শিক্ষা খাতে বাজেট ঘাটতি কাম্য নয়। দেশের মাত্র ১০ শতাংশ সরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে শিক্ষার গুণগত মান অর্জন সম্ভব নয়। তা ছাড়া সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় রয়েছে শিক্ষক ঘাটতি। ব্যানবেইসের শিক্ষা পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের মধ্যে সরকারি কলেজগুলোয় ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাতের বৈষম্য সবচেয়ে বেশি। সরকারি কলেজে ১০৫ জন ছাত্রের জন্য শিক্ষক রয়েছেন মাত্র একজন, অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে অনুপাত ১ : ১০৫। ৩০২টি সরকারি কলেজে সাড়ে ১৩ লাখ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১৩ হাজার। প্রাথমিকে এ অনুপাত ৪৩, মাধ্যমিকে ৪১, মাদরাসায় ৮৪ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০ জন। অথচ ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’-এ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১ : ৩০ ধরে তা ২০১৮ সালের মধ্যে অর্জনের কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে কি শিক্ষানীতির অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি? ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাতের বৈষম্য নিরসনের একটিই পথ এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আত্তীকরণ করে বদলির আওতায় আনা। যেহেতু সরকারি বিধি মেনে তারাও স্কুল-কলেজে নিয়োগপ্রাপ্ত হোন। সরকারি সুবিধাপ্রাপ্ত হলে শিক্ষকরা আনুষঙ্গিক পেশা ছেড়ে শিক্ষাঙ্গনে শতভাগ মনোযোগ দিতে পারবেন। এতে নিশ্চিত হবে শিক্ষার গুণগত মান ও শিক্ষকতায় আকৃষ্ট হবে মেধাবীরা। সুতরাং জাতীয় শিক্ষানীতি ও টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে শিক্ষা জাতীয়করণ এখন সময়ের দাবি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist