বাদল রফিক

  ১৫ জানুয়ারি, ২০১৮

নিবন্ধ

নৈতিক সংকট ও সংসদ নির্বাচন

ধনী দেশ আমেরিকার তিনজন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট গরিব হয়ে ঋণগ্রস্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। আরেক ধনী দেশ ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন পাউন্ডের তেজীভাব ছিল। কিন্তু এডওয়ার্ড হিথ মৃত্যুবরণ করেন একেবারে সাধারণ হাসপাতালে অতি সাধারণ মানুষের মতো। হিথের প্রধানমন্ত্রীর কার্যকাল শেষ হলে তিনি যখন ১০নং ডাউনিং স্টিট থেকে বিদায় নেন, তখন তিনি টেনিস খেলার র‌্যাকেট নিয়ে বিদায় হন। তিনি ছিলেন অবিবাহিত, তাই তার নেওয়ার মতো কিছুই ছিল না। পাশের দেশ ভারতের এক প্রধানমন্ত্রী দিল্লিতে এক দোকানে স্ত্রীর জন্য শাড়ি কিনতে গেলে দোকানি তার সামনে দামি দামি শাড়ি মেলে ধরেন। তখন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী বিনয়ের সঙ্গে জানান, ওগুলো নেওয়ার মতো অত টাকা তার নেই। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা ফজলুল হক ছিলেন খ্যাতিমান আইনজীবী। শেরেবাংলার ঝাউতলার বাড়িতে বহু লোক তাদের সমস্যা নিয়ে যেতেন নেতার কাছে। তিনি ওকালতি করে যা পেতেন, তা-ই অনেক সময় নিজের কথা না ভেবে দিয়ে দিতেন। অবিভক্ত বাংলার আরেক প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও ছিলেন নামকরা ব্যারিস্টার। তার সম্পর্কেও লোকমুখে এই ধরনের কথা প্রচলিত আছে। নিজের উপার্জিত সব অর্থই অন্যদের দিয়ে দিতেন তিনি। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, যিনি হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিলেন সমানভাবে জনপ্রিয়। তিনি তার বালীগঞ্জের পৈতৃক বাড়ি জনগণের জন্য উৎসর্গ করে দেশসেবায় নেমেছিলেন।

১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন, তখন সাংবাদিক সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমেদ পাকিস্তানের শিল্প-বাণিজ্য দফতরের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিযুক্ত হন। অবহেলিত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থে এবং পাকিস্তানে শিল্প বাণিজ্যের অনিয়মের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়ে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তাতে পশ্চিমা কায়েমি স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটায় তারা মন্ত্রী আবুল মনসুরের প্রতি ক্ষিপ্ত হন। সে সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানি করার জন্য জাহাজ ছাড়া আর কোনো যানবাহন ছিল না। এই উপকূল বাণিজ্যের জন্য তখন ৩৯টা জাহাজ ছিল। এতে জাহাজের অভাব হওয়ার কথা নয়, কিন্তু জাহাজ মালিকরা কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে জাহাজের ভাড়া দ্বিগুণ, তিন গুণ আদায় করে। ফলে পূর্বপাকিস্তানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অনেক বেশি হয়। মন্ত্রী আবুল মনসুর টনপ্রতি ৫১ টাকা ভাড়া বেঁধে ফরমান জারি করলেন। কিন্তু এতে কাজ হলো না, এই রেট অমান্য করে মালিকরা টনপ্রতি নব্বই-পঁচানব্বই টাকা আদায় করতে লাগলেন। জাহাজ মালিকদের যিনি প্রধান তিনি অসুস্থতার অজুহাতে ইজি চেয়ারে শুয়ে লোকের কাঁধে চড়ে মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলেন। তিনি খোলাখুলি মন্ত্রীকে বললেন টনপ্রতি একান্ন টাকা ভাড়া বেঁধে দেওয়া সরকারের ঘোরতর অন্যায় হয়েছে। মন্ত্রীর সমস্ত যুক্তি অগ্রাহ্য করে তিনি সগর্বে বললেন, বর্তমানে যে পঁচানব্বই টাকা ভাড়া আদায় করছেন এবং সে জন্য রসিদ দিচ্ছেন। ইচ্ছা করলে সরকার তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে।

মন্ত্রী অল্পদিন পরেই তার অফিসারদের মাধ্যমে জানতে পারলেন তার এই দুঃসাহসের হেতু। ওই ভদ্রলোক করাচির সবচেয়ে বড় ক্লাবে বসে সগর্বে অফিসারদের বলেছেন : ‘বলিয়া দিবেন আপনাদের মন্ত্রীকে, প্রেসিডেন্ট আমার ডান পকেটে। প্রধানমন্ত্রী আমার বাম পকেটে। অমন মন্ত্রীকে থোড়াই কেয়ার করি।’ মন্ত্রী যখন ভাবছিলেন যে সত্যি তিনি অসহায়, এই সময়ে তার কাছে এসব জাহাজ মালিকের নানা রকম শয়তানির কথা উল্লেখ করে বেনামি পত্র আসে যে, বন্দরে পড়ে থাকা অকেজো জাহাজ সমুদ্রে ডুবে গেছে দেখিয়ে সরকার ও ইনস্যুরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে টাকা আদায়ের ফন্দি চলছে। কিন্তিু তিনি নৌবাহিনীর প্রধান সেনাপতি অ্যাডমিরাল চৌধুরীর সাহায্য নিয়েও যখন এদের দৌরাত্ম্যের সঙ্গে পারলেন না তখন উপকূল বাণিজ্য জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নিলেন। এই লক্ষ্যে একটি বিলের খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠালেন। ন্যাশনাল শিপিং করপোরেশন গঠন করার সিদ্ধান্তে জাহাজের মালিকরা প্রেসিডেন্ট মির্জা ও প্রধানমন্ত্রী শহীদ সাহেবের কাছে ধরনা দিয়ে পড়লেন। মালিকদের প্ররোচনায় খবরের কাগজে হইচই পড়ে গেল, বাণিজ্যমন্ত্রী আবুল মনসুর দেশে কমিউনিজম আনছেন।

অনেকে মনে করেন সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার পতনের অন্যতম প্রধান কারণ তার এই প্রস্তাব। অসম্ভব নয়। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে জাহাজ মালিকদের যোগাযোগ পুরোদমে চলল। প্রেসিডেন্ট মন্ত্রীকে ধমকালেন। প্রধানমন্ত্রী আস্তে চল নীতি গ্রহণের উপদেশ দিলেন। তিনি আস্তে চললেন। অন্যদিকে বাণিজ্য সেক্রেটারি মি. আযিম আহম্মদও ছাড়ার পাত্র ছিলেন না, অ্যাডমিরাল চৌধুরী কমিশনের রিপোর্টে ওই জাহাজ মালিকের বিরুদ্ধে অনেক কুকীর্তির কথা বলা হয়েছে। তিনি মামলা করার পরামর্শ দিলেন, মন্ত্রী রাজি হলেন। যথাসময়ে চারটি মামলা দায়ের হয়ে গেল। বড়লোক আসামি বিলাত থেকে ব্যারিস্টার আনলেন। সরকারপক্ষ থেকে বিলাতি ব্যারিস্টার আনার কথা হলো। পাবলিক প্রসিকিউটর মি. রেমন্ড বললেন তিনিই যথেষ্ট। একটা মামলায় সরকারের জিত হলো, বাকি তিনটা মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার পতন ঘটল।

আবুল মনসুর আহম্মদ আতাউর রহমান খানেরা রাজনীতি করে মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। ক্ষমতাকে প্রয়োগ করেছেন জনস্বার্থে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে। রাজনীতিবিদ হিসেবে তাদের সততা সেই চারিত্রিক দৃঢ়তা ছিল, যে কারণে জনগণের স্বার্থরক্ষায় তারা ছিলেন এক অকুতোভয় যোদ্ধা। বর্তমানে আমাদের রাজনীতিতে কোথায় সেই নীতিনৈতিকতা? নীতি আদর্শবর্জিত রাজনীতির দ্বারা আমাদের সমাজ কলুষিত। ‘রাজনীতি এখন ধনীদের খেলা’। এই মন্তব্য অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের। তিনি সম্প্রতি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তৃতায় বলেছেন, ‘রাজনীতি এখন ব্যবসার সম্প্রসারিত অংশ হয়ে গেছে। আর টাকা হলো নির্বাচনের জেতার পথ।’ তিনি আরো বলেন, ‘গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক শৃঙ্খলাকে ক্ষয় করছে। নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব দেখা যাচ্ছে না। দলগুলোর ভেতরে অর্থ ও পেশিশক্তি প্রবেশ করছে। এর ফলে রাজনীতি ধনীদের খেলায় পরিণত হয়েছে।’

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৬ বছর আগে, অথচ আমাদের দেশে রাজনীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি, গড়ে উঠেনি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। জনগণের জন্য সুশাসন এখনো সুদূর পরাহত। দেশের রাজনীতিবিদরা জাতীয় সমস্যায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে পারে না। দেশে উন্নয়ন হয়তো হয়েছে, হয়নি সম্পদের সুষম বণ্টন, উচ্চবৈষম্য ও সমাজে ন্যায্যতা নেই। কিন্তু তার পরও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে রাজস্ব আদায় বাড়ছে। এতে বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। মানব উন্নয়নে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে। তবে, রাজনীতি কলুষিত হওয়ায় কোনোভাবেই সমাজে ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না।

পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ থেকে পূর্ব বাংলার মানুষ তথা আজকের বাংলাদেশের মানুষ আন্দোলন করেছিল গণতন্ত্রের জন্য, ২২ পরিবারের শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন এখনো সূদর পরাহত। আজও একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা যা দেশ এবং বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে, তার জন্য আমাদের হাপিত্যেশ করতে হচ্ছে। কথায় আছে ‘কোনো কাজ শুরু যদি ভালোভাবে করা যায়, তাহলে নাকি সে কাজের অর্ধেক হয়ে যায়।’ ৯০-এর পর উচিত ছিল তিন জোটের রূপরেখায় আন্দোলনকারী রাজনৈতিক শক্তিগুলো মিলে অন্তত দুই বছরের জন্য হলেও একটি জাতীয় সরকার গঠন করা। যে সরকার দেশে দীর্ঘদিন গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে সমাজ, রাষ্ট্রে যেসব অনিয়ম তৈরি হয়েছে সেই ক্ষত সারাবে। এই কথা অবশ্য ৭১-এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও অনেকে মনে করেন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ঐক্যবদ্ধ থেকে একটি জাতীয় সরকার করে অন্তত পাচ বছর গণতান্ত্রিক সমাজের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য একসঙ্গেহ পথচলা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা হয়নি।

৭১-পরবর্তী সময়ের ভুল ও ৯০-এর ভুলই আজ ক্রমে-ক্রমে বর্তমান সংকটের জন্ম দিয়েছে। রাজনীতি কলুষিত, সমাজ-রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি আজ অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে রয়েছে। আগামী ১৯১৯ সালে ১১তম সংসদ নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদেরই। প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য, প্রয়োজন তরুণ আদর্শবাদী নেতৃত্ব। এই নতুন নেতৃত্বের আশায় দেশবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist