শুভাশিস ব্যানার্জি

  ১৪ জানুয়ারি, ২০১৮

প্রযুক্তি

প্রতিরক্ষাবলয় সময়ের দাবি

আজকাল সামাজিক যোগাযোগ সাইটে সাইবার ক্রিমিনালদের হামলার শিকার খোদ রক্ষকও। সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইট এবং ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাইবার ক্রাইমের পরিমাণও বেড়েছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের ভুলের জন্যই আমরা সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়ে থাকি। কিন্তু একটু সচেতন থেকে কয়েকটি বিষয় মেনে চললে অনেকাংশে এড়ানো যেতে পারে এই অযাচিত হয়রানি।

আইসিটি হচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিদ্যার এমন একটি শাখা যার মাধ্যমে বৈদ্যুতিক উপায়ে তথ্য সংযোগ, সংগ্রহ, গঠন, প্রচার, বিতরণ ও বদলানো যায়। এই বৃহৎ সংসারের মধ্যে যেসব বিষয় থাকে তা হলো রেডিও, টেলিভিশন, ভিডিও, ডিভিডি, টেলিফোন (সাধারণ ও মোবাইল দুই ধরনের) বেতার ব্যবস্থা, কম্পিউটারের নেটওয়ার্ক, হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার এবং এই প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত আরো কাজ ও পদ্ধতি যেমন ভিডিও-কনফারেন্সিং, ই-মেল ও ব্লগস। ‘তথ্য যুগে’ শিক্ষার উদ্দেশ্য পূরণ করতে হলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির আধুনিক কাঠামোকে শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করা দরকার। এই কাজ সঠিকভাবে করার জন্য শিক্ষার পরিকল্পনাকারীরা, অধ্যক্ষ, শিক্ষক এবং প্রযুক্তিবিদদের নানা ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যেমন : কারিগরি ক্ষেত্র, প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র, আর্থিক ক্ষেত্র, শিক্ষণ প্রণালি ক্ষেত্র এবং পরিকাঠামোগত ক্ষেত্র। বিশ্বজুড়ে ‘র‌্যানসমওয়্যার’ ভাইরাসের হামলায় কয়েক লাখেরও বেশি কম্পিউটার আক্রান্ত হলেও এটাই শেষ নয়, বরং আরো মারাত্মক ও বড় আকারের সাইবার হামলা ঘটতে চলেছে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একটি আন্তর্জাতিক সাইবার সিকিউরিটি ফার্ম প্রুফ পয়েন্ট সংবাদ সংস্থা এএফপিকে এই সতর্কবার্তা জানিয়ে বলেছে, র‌্যানসমওয়্যারের মতোই ক্ষতি করবে এমন নতুন ভাইরাস ‘এডেলকুজ’ হানা দিতে চলেছে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে। প্রুফ পয়েন্ট সংস্থার বিশেষজ্ঞরা সবাইকে সাবধান করে দিয়ে বলেছেন, ‘এডেলকুজ’-এর সঙ্গেই যুক্ত আর একটি নতুন ভাইরাস হানা দিতে চলেছে সাইবার দুনিয়ায়। এই ভাইরাস হানা দিলে কম্পিউটারের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবেন তার বৈধ ইউজার। ভার্চুয়াল কারেন্সি না দিলে খোলা যাবে না কম্পিউটারের ‘লক’।

প্রুফ পয়েন্টের গবেষক নিকোলাস গদিয়ের বলছেন, ‘এডেলকুজ’ অত্যন্ত উচ্চমানের ও সর্বশেষ প্রযুক্তির কিছু হ্যাকিং টুলস ব্যবহার করে। এখনো মাইক্রোসফটের প্রতিকার খুঁজে পায়নি। কম্পিউটারকে পুরোপুরি স্তব্ধ না করে ‘এডেলকুজ’ ভাইরাস সিস্টেমের ব্যাকগ্রাউন্ডে তথ্য চুরির মতো ‘কুকীর্তি’ করে যায়। হ্যাকাররা এই ভাইরাস কম্পিউটারে পাঠিয়ে ভার্চুয়াল কারেন্সি দাবি করে। এ ক্ষেত্রেও মনেরো বা বিটকয়েনের মতো কারেন্সি চাওয়া হয়। ‘এডেলকুজ’ হানা দিলে একজন সাধারণ ইউজার বুঝতেও পারবেন না, কারণ এ ক্ষেত্রে র‌্যানসমওয়্যার হানার মতো কম্পিউটারের পর্দায় কোনো মেসেজ ফুটে উঠবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাইবার ক্রিমিনালদের কাছে এই ভাইরাস অনেক বেশি লাভজনক। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, গত ২ মে থেকে এই ভাইরাস সাইবার দুনিয়ায় ঢুকে পড়েছে। যদিও এখনো মহামারীর আকার নেয়নি এই ভাইরাস। তবে কয়েক মাসে বিশ্বের বেশ কিছু সিস্টেমে সন্দেহজনকভাবে ভার্চুয়াল কারেন্সির লেনদেন বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছে প্রুফ পয়েন্ট।

ব্যাংক ডাকাতদের এখন আর ব্যাংকের ভোল্ট ভাঙতে হয় না। অনলাইনের মাধ্যমে ঘরে বসেই হাতিয়ে নিতে পারে ব্যাংকের তথ্য আর অর্থ। গত কয়েক বছরে সাইবার ক্রাইম বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। বার্ষিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর ১.৫ মিলিয়নবার বিভিন্ন হ্যাক হয়ে থাকে। হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার সাইবার অ্যাটাক হয়। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সবাই এই সাইবার ঝুকিতে রয়েছে। বিশ্ববাজারেও পড়েছে এই সাইবার ক্রাইমের প্রভাব। ঝুঁকি আর উদ্বিগ্নতায় রয়েছে বিশ্বের বড় বড় আর্থিক কোম্পানিও।

২০১৬ সালে দেশের ব্যাংকিং খাতে আলোচিত বিষয় ছিল সাইবার হামলা। ফেব্রুয়ারির শুরুতে সাইবার হামলার মাধ্যমে হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরি করে। একই মাসের মাঝামাঝি বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের এটিএম বুথেও সাইবার হামলা হয়। এই ঘটনার পর সাইবার নিরাপত্তা বা আইটি সিকিউরিটিতে খরচ বাড়িয়েছে অধিকাংশ ব্যাংক। ২০১৭ সালে সাইবার নিরাপত্তাব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করতে বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। ইতোমধ্যে সব বেসরকারি ব্যাংকে আইটি সিকিউরিটি নামে আলাদা বিভাগ গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে আইটি বিশেষজ্ঞদেরও।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর একটি অনলাইনকে বলেন, যে ব্যাংকের আইটি বিভাগ যত উন্নত, সেই ব্যাংকের গ্রাহকসেবাও তত উন্নত। আগামী দিনের ব্যাংকিং হবে পুরোপুরি আইটি তথা প্রযুক্তিনির্ভর। এ কারণে আইটি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ব্যাংকগুলোকে গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করতে হবে। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরি ও এটিএম বুথে জালিয়াতির পর ব্যাংকগুলোর সাইবার নিরাপত্তা জোরদারে বিভিন্ন নির্দেশনা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নির্দেশনা অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যাংকে ফায়ারওয়াল স্থাপন, নিয়মিত ভিত্তিতে তথ্য যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, সব এটিএম বুথে অ্যান্টি স্কিমিং ডিভাইস স্থাপন ও পিন শিল্ড ডিভাইস বসানো এবং স্বয়ংক্রিয় এসএমএসের মাধ্যমে লেনদেনের তথ্য সংরক্ষণ করতে বলা হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার পর ব্যাংকগুলো বর্তমানে অনেক সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। অধিকাংশ ব্যাংক আলাদা আইটি বিভাগ করার পাশাপাশি বুয়েট বা আইটি অভিজ্ঞদের নিয়োগ দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমীন বলেন, ব্যাংকের আইটি নিরাপত্তা খাতে ব্যয় আগের চেয়ে অনেক বাড়ানো হয়েছে। গ্রাহকের আস্থা ধরে রাখতে এই মুহূর্তে ব্যাংকগুলো সাইবার বা সিকিউরিটি নিরাপত্তার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তিনি আরো বলেন, ইতোমধ্যে সব ব্যাংকই আগের এটিএম কার্ডের ধরন পরিবর্তন করে উন্নতমানের করেছে। এ ছাড়া সব ব্যাংক নিরাপত্তাব্যবস্থারও উন্নয়ন করেছে। এই খাতে সবাই ব্যয়বৃদ্ধি করেছে। ব্যাংকগুলো এখন থেকে আইটি খাতে মেকার, চেকার ও সুপারভাইজার এই তিন ধরনের লোক নিয়োগ দিচ্ছে।

গত বছর এমন সাইবার ক্রাইমের কবলে পড়েছে আরো বেশ কিছু দেশ ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ই-পেমেন্ট সার্ভিস। ব্রাজিলিয়ান পেমেন্ট সার্ভিস থেকে প্রায় ৩.৭৫ বিলিয়ন টাকা চুরি করে নিয়েছিল হ্যাকাররা। সব ধরনের সাইবার ক্রাইম মোকাবিলায় সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে জোর প্রস্তুতি প্রয়োজন। সেই সঙ্গে জনমনে আস্থা যা কিনা ব্যাপক গণসচেতনতার মাধ্যমেই আনা সম্ভব। গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থা এখন আইসিটিনির্ভর। তাই ব্যাংকিং সেক্টরে আইসিটি নীতিমালা যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। দু-তিন বছর আগের কোনো প্রযুক্তি প্রস্তাবনা হয়তো আজকের বাস্তবতায় অচল বা অকেজো হয়ে আছে। প্রায় প্রতিদিনই প্রযুক্তিনির্ভর প্রতারণার নিত্যনতুন কৌশল বের হচ্ছে। এ সময়ে প্রযুক্তিনির্ভর প্রতারণা থেকে রক্ষা পেতে গণসচেতনতা সবচেয়ে বেশি দরকার। এর পাশাপাশি-প্রযুক্তিনির্ভর প্রতারণা এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধ বিষয়ে আইসিটি আইন ২০০৯-এর বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে আইনটির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে প্রান্তিক পর্যায় থেকে কাজ শুরু করেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশন ২০২১, এখন ২০৪১-এর লক্ষ্যে কাজ করছে। জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জীবনমানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার অঙ্গীকার এটি। বাংলাদেশ যতই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ যতই ২০২১-এর মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে, ততই ‘সাইবার সিকিউরিটি থ্রেট’ প্রকট আকার ধারণ করছে। প্রযুক্তিনির্ভর প্রতারণা এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধ বিষয়ে আইসিটি আইন ২০০৯ (দ) ধারায় হ্যাকিংয়ের শাস্তি হলো ‘কোনো ব্যক্তি যদি (ক) ও (খ) ধারায় কোনো অপরাধ সংঘটিত করেন তাহলে হ্যাকিংয়ের শাস্তি হিসেবে ‘তিনি অনধিক ১০ বছর কারাদ-ে বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদ-ে বা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। তবে হ্যাকাররা কখনোই প্রচলিত আইনের তোয়াক্কা করে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েই অদৃশ্য শক্তির মোকাবিলা করতে হয়। হ্যাকাররা অনেক ক্ষেত্রেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের শক্ত সংগঠন হয়ে থাকে। মেধাবী শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে প্রফেশনালদের সঙ্গে নিয়ে ‘আরঅ্যান্ডডি’ অ্যাকশনেবল ইন্টেলিজেন্স ল্যাব গঠন করে দেশে একঝাঁক প্রফেশনাল বুদ্ধিমত্তার জন্ম দিতে হবে। হ্যাকিংয়ের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে পাল্টা প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষা। এই প্রতিরক্ষাবলয় তৈরি আধুনিক সময়ের অন্যতম প্রধান দাবি।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist