মুহাম্মদ কামাল হোসেন

  ১৩ জানুয়ারি, ২০১৮

সরেজমিন

কানটুপি ও শীতার্ত মানুষ

কানে ‘ফুঁ’ দিচ্ছে ঠান্ডা বাতাস। ঘর থেকে বের হওয়াই দায়। জবুথবু অবস্থা। সারা দিন শেষে বিকেলে এক কফিশপে দুই বন্ধু কথা বলছিলাম কফির মগে চুমুক দিতে দিতে। হঠাৎ মধ্যবয়স্ক এক লোক এসে সরাসরি কথার মাঝখানে বাম হাত (!) ঢুকিয়ে দিল। ধ্যাত! কিছুটা বিরক্তি নিয়ে লোকটির দিকে তাকালাম। আমার ঘাড় ত্যাড়া বন্ধুটি আরো একধাপ এগিয়ে লোকটিকে কিছু বলতে যাচ্ছিল, অমনি খেয়াল করলাম লোকটির আস্ত ডান হাতখানাই নেই! শরীরেও ময়লা ছেঁড়া একখান জামা। শীতে রীতিমতো কাঁপছে ঠকঠক করে!!

‘বাবাগো, শীতে খুব কষ্ট পাচ্ছি। একটা কানটুপি হবে?’

বন্ধুটি চট করে উত্তর বসিয়ে দিল,

‘চাচা, এটা কফিশপ। কানটুপির দোকান না। অন্যখানে যান’

লোকটি চলে যেতে পা বাড়াল। আমি তাকে হাতে ইশারা করলাম।

‘চাচা, একটু দাঁড়ান’

‘বাবা কিছু বলবা?’

‘হুমমম...আপনাকে কানটুপি কিনে দেব, কিন্তু শুধু কানটুপি কেন? আপনার শরীরে তো কোনো শীতের কাপড়ই নেই?’

‘বাবা, লজ্জার কথা কী আর বলব। গরিবেগো আবার শীত!’

‘সেকি(!) শীতের আবার ধনী-গরিব জাতভেদ আছে নাকি? তাছাড়া এখানে লজ্জাইবা কেন?’

‘বাবাগো, কথায় বলেÑবেডাগো (পুরুষ) শীত কানে বেডিগো (মহিলা) শীত...!’

এবার আমি সরাসরি টাসকি খেয়ে গেলাম! চাচা, কয় কী!! কোনোমতে হাসি সংবরণ করে লোকটিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। নিকটস্থ এক দোকানে গিয়ে ভালো একখানা কানটুপিওয়ালা জ্যাকেট কিনে চাচার হাতে তুলে দিলাম।

‘এই নিন চাচা। গায়ে জড়ান জলদি’

‘বাবাগো আল্লাহ তোমাকে বাঁচাক। দোয়া করি’

মনে মনে বিড় বিড় করে বলি, বাঁচালে আল্লাহই বাঁচাবে। বেশ কদিন থেকে দেশব্যাপী ‘লু’ হাওয়া বইছে। কানে ‘ফুঁ’ দিয়ে যাচ্ছে। শীতে জর্জরিত জনজীবন। অসহায় লোকটির হাসিখুশি মুখটি বারবার চোখের সামনে ভেসে ওঠতে লাগল। পকেট হালকা হয়েছে বলে নয়, বরং ভালো একখান কাজ করতে পেরেছি বলে শান্তি লাগছে। এভাবে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সমাজের প্রত্যেকে এগিয়ে এলে শীতার্ত মানুষদের কষ্ট থাকে না। অনেকটা লাঘব হয়ে যায়।

২. প্রকৃতিতে তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে হঠাৎ নেমে এসেছে কনকনে শীত। মাঘে নয়, এবার যেন পৌষেই বাঘ কাঁপনো ঠান্ডা নেমেছে। বাঘেরও দফারফা। ছেড়ে দে মা কাঁদি অবস্থা। গোটা দেশ কাঁপছে শীতে। প্রতিদিন নামছে তাপমাত্রা। ঘন কুয়াশা উসকে দিচ্ছে শীতের মাত্রার তীব্রতা। উত্তর দিক থেকে আসা হুল ফোটানো শীতল বাতাস আর কনকনে ঠান্ডা দেশের উত্তরাঞ্চলে আগেভাগে শুরু হওয়ার পর এখন ধেয়ে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলের দিকে। দেশের প্রায় সব জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ। ক্রমেই শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের অবস্থা ভয়াবহ। দিনে সূর্যের দেখা মিলছে না এ অঞ্চলে। ফলে তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশায় একেবারেই বিপর্যস্ত এ এলাকার সাধারণ মানুষ। সব মিলিয়ে চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এ এলাকার খেটে খাওয়া মানুষ। এলাকার বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে ও চায়ের দোকানে শীত নিবারণের চেষ্টায় আগুন জ্বালিয়ে উত্তাপ নিতে দেখা গেছে নিম্ন আয়ের মানুষগুলোকে। তীব্র শীতে প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না। ফলে সবথেকে বেশি সমস্যায় পড়েছে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলো। পেটের তাগিদে সেই কাকডাকা ভোরে গ্রাম থেকে কাঁপতে কাঁপতে শহর পথে ছুটে আসা শহর পানে। জবুথবু অবস্থায় শ্রম বিক্রির স্থানে জড়ো হওয়া। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে থমকে গেছে উন্নয়ন কর্মকান্ড। ফলে বেশির ভাগ শ্রমজীবী মানুষ থাকছে কর্মহীন। আর কাজ না থাকা মানে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনাহার-অর্ধাহার। রিকশাচালক মুটে-মজুর, ফুটপাতের ব্যবসায়ী সবাই পড়েছে শীত দুর্ভোগে। হিমেল হাওয়ার কারণে লোক সমাগম কম হওয়ায় বড় বড় বিপণিবিতানে তার প্রভাব। হিমেল হাওয়ার মধ্যেও যারা পেটের তাগিদে ফুটপাতে পসরা নিয়ে বসেছিলেন; তাদেরও ছিল না প্রত্যাশিত ক্রেতা। তবে শীত নিবারণের জন্য ফুটপাতের গরম কাপড়ের দোকানে ভিড় বেশ ভালোই ছিল। বিভিন্ন বিপণিবিতানের গরম কাপড়ের দোকানে জ্যাকেট, সোয়েটার, মাফলার, টুপির বিক্রি বেশ ভালো। তবে শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব কাপড়ের দামে উত্তাপ বেড়েছে। ব্যবসায়ীদের সোজাসাপ্টা জবাব, এটা সিজনাল ব্যবসা। অনেক টাকা বিনিয়োগ করে মালামাল কিনতে হয়। তাই সবাই চেষ্টা করেন মুনাফার। তবে খুব বেশি নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ মার্কেট প্রতিযোগিতার। বেশির ভাগ দোকানেই কিছুটা মানসম্পন্ন সোয়েটার হলেই এক দামে বিক্রি হচ্ছে এবং ক্রেতারাও খুব বেশি বাক্য ব্যয় না করে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। যে সোয়েটার এই কদিন আগেও একশ থেকে দেড়শ টাকায় বিক্রি হতো এখন তা দুশ থেকে তিনশ টাকায় এক দামে বিক্রি হচ্ছে। গ্রামের দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষের কষ্টের সীমা নেই। কেবল কাঁথা জড়িয়ে ও আগুন জ্বালিয়ে এখন আর রাত কাটতে চায় না। শীত মোকাবিলার জন্য আরো কিছূ চাই। একটা কম্বল হলেও চলে যেত। কিন্তু দিন এনে দিন খাওয়ার অবস্থা যাদের তাদের কম্বল কেনার সামর্থ্য হয় না। বেড়েছে রুম হিটারের চাহিদা ও দাম। শীত বিপর্যস্ত করেছে বিশেষত ছিন্নমূল মানুষ ও চরাঞ্চলের মানুষদের। ঘন কুয়াশার কারণে দিনের অর্ধেক সময় পার হলেও সূর্যের দেখা মিলছে না। শীতের তীব্রতা আর ঘন কুয়াশার কারণে শিশু এবং বয়োবৃদ্ধদের ঠান্ডাজনিত রোগবালাই বেড়েই চলছে। তারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে। সারা দেশেই শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। তাদের চিকিৎসায় অভিভাবকদের ছুটতে হচ্ছে হাসপাতাল টু হাসপাতালে। ঘরে ঘরে শিশুরা আজ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হাসপাতালগুলোতে শিশুদের আধিক্য লক্ষণীয়। ঠান্ডাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাবে প্রতিদিন অনেক শিশু মারাও যাচ্ছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে কোমলমতি শিশু-কিশোররা স্কুলে-কলেজেও যেতে পারছে না। শীত নিবারণের জন্য প্রত্যেকে সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

৩. চলমান বৈরী আবহাওয়ার কারণে উৎপাদন ব্যবস্থাও কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। দেশের বাজারগুলোর চিত্র খুব একটা সন্তোষজনক নয়। শীতকালীন বিভিন্ন শাকসবজির দাম এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে লাগামহীন বেশি। উৎপাদন ব্যবস্থা কমÑএই অজুহাতে ব্যবসায়ীরা জিনিসপাতির উচ্চমূল্য হাঁকাচ্ছেন। শীতার্ত সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। শুধু তাই নয়, তীব্র শীতের কারণে ইতোমধ্যে ইরি ধানের বীজতলা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। হলুদ হয়ে যাচ্ছ বীজতলাগুলো।আলুক্ষেতে ছত্রাক-পচন দেখা দিয়েছে। শীতের প্রকোপ এভাবে আরো কিছুদিন অব্যাহত থাকলে আলু, গম, ভুট্টাসহ শাকসবজির ফলন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিপদের ওপর বিপদের হাতছানি। দিশাহীন অসহায় মানুষগুলো উ™£ান্তের মতো ছুটছে। বছরব্যাপী বৃষ্টি বিড়ম্বনা ও দুর্ভোগের পর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে হাজির হয়েছে অসহনীয় শীতের লাগামহীন তীব্রতা। দেশের পত্রপত্রিকাগুলো বলছে, বিগত ৭০ বছরের রেকর্ড ভেঙে গেছে। দুর্যোগপূর্ণ শীতে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষগুলো মরছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে অসংখ্য ছিন্নমূল মানুষের অবস্থান রয়েছে। তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যানও নেই। তবে তাদের শীত নিবারণের জন্য সমাজের অবস্থাসম্পন্ন মানুষগুলো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। সমাজের বিত্তবান ও মানবিক বোধসম্পন্ন ব্যক্তিরা যদি দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে না দাঁড়ান, তা হলে মানুষের দুুর্ভোগ শুধু বাড়বেই। এ ক্ষেত্রে সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ববোধ থেকে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যক্তিপর্যায়ের উদ্যোগের মাধ্যমে এমন পরিস্থিতি থেকে শীতার্তদের রক্ষা করা যায়। শীতার্ত অভাবী মানুষদের পাশে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন এনজিও কিংবা প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রয়াসই পারে শীতার্ত মানুষের মুখে এক চিলতে হাসি ফোটাতে।

লেখক : সাহিত্যিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist