ইফতেখার আহমেদ টিপু

  ১১ জানুয়ারি, ২০১৮

বিশ্লেষণ

যৌতুক একটি অভিশাপ

যৌতুকের জন্য নরসিংদীর রায়পুরার এক গৃহবধূ পাষ- স্বামী, দেবর ও শ্বশুরের বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সুমী নামের ওই গৃহবধূ বাবার বাড়ি থেকে যৌতুক হিসেবে তিন লাখ টাকা এনে দিতে অস্বীকার করায় তার স্বামী কবির মিয়া বেধড়ক মারধর করেন, দেবর মাথার চুল ও ভ্রু কেটে দেন এবং শ্বশুর পুত্রবধূর হাতে সিগারেটের ছেঁকা দিয়ে যৌতুক না পাওয়ার ক্ষোভ চরিতার্থ করেন। গত শনিবার রায়পুরার জাহাঙ্গীরনগর গ্রামে ঘটে এই পৈশাচিক ঘটনা। খবর পেয়ে সুমীর বাবার বাড়ির লোকজন তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন। এ ব্যাপারে রায়পুরা থানায় পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

গৃহবধূ সুমীর বাবার অভিযোগ, বিয়ের পর সুমী বিভিন্ন সময় বাবার বাড়ি থেকে ৬০ হাজার টাকা এনে দিয়েছেন যৌতুকলোভী স্বামীকে। সম্প্রতি ঘর নির্মাণের জন্য তিন লাখ টাকা এনে দেওয়ার দাবি জানালে সুমী অস্বীকার করেন। এরপর থেকে তার ওপর নেমে আসে নির্মম অত্যাচার। যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতন এ দেশের একটি নিত্যকার ব্যাপার। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যৌতুকের প্রবণতা অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও গ্রাম এলাকায় এ অভিশাপের প্রভাব এখনো প্রবলভাবে অনুভূত হয়। নারী নির্যাতনের এক বড় অংশের সঙ্গে যৌতুকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। যৌতুকের বিরুদ্ধে দেশে কড়া আইন থাকলেও জনসচেতনতার অভাবে এই অভিশাপের কবল থেকে রেহাই মিলছে না। সমাজের দরিদ্র ও নিরক্ষর অংশের মধ্যে যৌতুকজনিত নির্যাতনের ঘটনা বেশি। মনুষ্য চেহারার যৌতুকলোভী ঘৃণ্য জীবেরা যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারাসহ সব ধরনের নির্মমতা দেখিয়ে আসছে। রায়পুরায় যৌতুকের দাবিতে গৃহবধূর ওপর স্বামী, শ্বশুর ও দেবরের পৈশাচিক নির্যাতন যৌতুকলোভীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে।

আমরা আশা করব, অপরাধীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে বিচারের জন্য সোপর্দ করা হবে। বিচারের মাধ্যমে অপরাধীদের যাতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় সে ব্যাপারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সম্ভাব্য সবকিছু করবে। আমরা মনে করি যৌতুকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার দিকেও নজর দিতে হবে। এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার সদস্যদের দায়বোধের মধ্যে নিয়ে আসার বিষয়টিও ভাবা যেতে পারে।

বাংলাদেশে যৌতুক আইনত নিষিদ্ধ, দ-নীয় অপরাধ। তার পরও যেন তা প্রথায় পরিণত হয়েছে। সমাজের বিত্তবানদের জন্য যৌতুক কোনো সমস্যা না হলেও নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য তা বড় সমস্যা। বিদ্যমান আইনটি সময়োপযোগী করার জন্য সম্প্রতি ‘যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৭’-এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। খসড়ায় বলা আছে, যৌতুকের জন্য কোনো নারীকে মারাত্মক জখম করলে যাবজ্জীবন কারাদ-, আত্মহত্যার প্ররোচনার জন্য ১৪ বছরের কারাদ- দেওয়াসহ বিভিন্ন অপরাধের জন্য পৃথক শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। খসড়াটি এখন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে যাবে। এরপর আবার মন্ত্রিসভায় এলে তা চূড়ান্ত হবে। শুধু আইন থাকলেই হবে না, প্রয়োজন তার যথাযথ ব্যবহার। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আইনের প্রয়োগ নেই। আবার গ্রামাঞ্চলের অনেক মানুষ আইনটি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত নয়। প্রচার ও প্রয়োগের দুর্বলতার কারণেও সমাজ থেকে যৌতুক নামের অভিশাপ দূর করা সম্ভব হয়নি। ফলে যৌতুকের জন্য নারী নির্যাতন চলছে। প্রাণ দিতে হচ্ছে অসহায় নারীদের।

সমাজ থেকে যৌতুকপ্রথা বিলোপ করতে হবে। যৌতুকের জন্য নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি। নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে সমাজ যৌতুকের অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে। মনে রাখতে হবে, অনাদর, অবহেলার মধ্য থেকে ভালো কিছুর জন্ম কখনো হতে পারে না, হওয়ার নয়। তাই শিক্ষা, যোগ্যতা আর দক্ষতার মাপকাঠিতে নিজের ছেলে আর মেয়ের বেলায় যেন হয় সমানে সমান। ঘরের ছেলেকে যোগ্য হাতিয়ার আর মেয়েকে সাজের পুতুল বানানোর মধ্যে অহঙ্কারের কিছু নেই। প্রকৃতপক্ষে নারী জীবনের যে সবদিক সম্পর্কে যেমন অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা, যোগ্যতা, দক্ষতা, স্বাস্থ্য, প্রজনন, বৈবাহিক অবস্থা সব বিষয়ে নারীর অবস্থান নির্ধারণ জরুরি।

উন্নয়নশীল বাংলাদেশে যৌতুক এখন একটি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা যেমন সমাজের মধ্যে অভিশাপ হিসেবে বাস করে চলছে। আমরা মনে করি, যৌতুকের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে সরকারের পাশাপাশি সমাজের সচেতন মহলকেও এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

লেখক : চেয়ারম্যান ইফাদ গ্রুপ

পযধরৎসধহ@রভধফমৎড়ঁঢ়.পড়স

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist