হাসান জাবির

  ১১ জানুয়ারি, ২০১৮

মতামত

বৈশ্বিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ কোনদিকে

২০০৭ সালে রাশিয়া কনভেনশনাল আর্মস ফোর্সেস ইন ইউরোপ ট্রিটিÑঅর্থাৎ ইউরোপে ভারী অস্ত্র মোতায়েন করা না করা-সংক্রান্ত স্নায়ুযুদ্ধকালীন চুক্তিটি একতরফাভাবে স্থগিত করে। ৯০-পরবর্তী ইউরোপের শক্তির ভারসাম্য ফেরাতে এই পদক্ষেপ রুশ শক্তির কৌশলগত সম্প্রসারণ আকাক্সক্ষারই বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এতে করে ইউরোপের রণনিরাপত্তার প্রশ্নটি নতুন মোড় নেয়। একই সঙ্গে ইউরোপে রুশ আগ্রাসনের পূর্বতন আতঙ্ক নতুন আঙ্গিকে ইউরোপীয় দেশগুলোকে আতঙ্কিত করে তোলে। এ কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়ার টেনশান বৃদ্ধি পায়। এরপর রাশিয়া তার সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নে মনোনিবেশ করলে ইউরোপের নিরাপত্তার প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

পর্যায়ক্রমে পূর্ব ইউরোপ ও সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রসমূহে অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তার করার প্রয়াস নেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষত রুশ রাজনৈতিক শক্তির কৌশলগত দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে বাল্টিক এলাকা, ইউক্রেন ও জর্জিয়া লক্ষ করে মার্কিন পরিকল্পনা

এগোতে থাকে। মূলত ওই অঞ্চলে, আরো শক্তি সমাবেশ

ঘটানোর পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রুশ

ইউক্রেন, রুশ জর্জিয়া সম্পর্কের অবনতি হলে আঞ্চলিক

পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অবস্থান সংহত হয়। এ ক্ষেত্রে রুশ জাতীয় সীমানাসংলগ্ন এলাকায় মার্কিন আধিপত্য

বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈশ্বিক ক্ষমতার চাবিকাঠি যুক্তরাষ্টের অনুকূলে রাখতে সহায়তা করে। যদিও এর আগে আমেরিকা

মহাদেশে বামপন্থিদের উত্থান ওয়াশিংটনের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে। বিশেষত আঞ্চলিক রাজনীতিতে কিউবার নেতৃস্থানীয় ভূমিকা ভেনিজুয়েলাসহ আরো কয়েকটি দেশের ওয়াশিংটন বিমুখিতা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক আধিপত্যের জন্য কৌশলগত হুমকি হিসেবে দেখা হয়। এ পর্যায়ে আরব বসন্ত, ইউক্রেন সংকটকে কেন্দ্র করে দুনিয়াজুড়ে সামরিক উত্তাপের নির্যাস যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে বিদ্যমান বিরোধের সম্প্রসারণ ঘটায়। বিশেষত সিরিয়া ইস্যুতে এখনো উভয় দেশ মুখোমুখি লড়াইয়ের পর্যায়ে রয়েছে।

অন্যদিকে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার বর্ধনশীল সামরিক সক্ষমতা, আফ্রিকা চীন সম্পর্কের গভীরতা, ইউরোপের জ্বালানি নিরাপত্তায় একচেটিয়া রুশ আধিপত্য, জার্মানি ও ফ্রান্সের সঙ্গে মস্কোর সম্পর্কের নতুন মাত্রা ইত্যাদি ঘটনার প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্রের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক আধিপত্যের একক নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে ধীরে ধীরে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির গতিপথ পরিবর্তিত হতে থাকে। এ পর্যায়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভঙ্গুরতা, সিরিয়া ও ইউক্রেন সংকটের সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের মধ্যে সম্প্রতি মনোমালিন্য কমিয়ে আনে। অন্যদিকে বৃহত্তর ইউরোপীয় ঐক্যের সাধারণ ধারণার প্রচ্ছন্ন প্রভাব পরে রুশ-ফ্রান্স, রুশ-জার্মানি সম্পর্কের বর্ধনশীল উষ্ণতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা রাশিয়ার জাতীয় স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটিয়ে মস্কোর বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের প্রবল আগ্রহকে কৌশলগতভাবে সংকুচিত করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্নায়ুযুদ্ধের আবহে রুশ-ইউরোপ সম্পর্কে মৃদু উত্তাপ লক্ষ করা যায়। অবশ্য তার আগে এশিয়ায় চীনের অর্থনৈতিক উত্থান। বেজিংয়ের অব্যাহত সামরিক অগ্রযাত্রা, রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের অভিপ্রায় বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামোর একপক্ষীয় আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। প্রায় একই সময় রাশিয়া ও চীনের বিশ্ব ভূমিকা পালনের ব্যাপক আগ্রহের ফলে যুক্তরাষ্ট্রর বৈশ্বিক ক্ষমতা চ্যালেঞ্জে পড়ে। এই উঠতি বিকল্প কাঠামোটিকে কেন্দ্র করেই আজকের দুনিয়ার ক্ষমতা কাঠামোর রূপরেখার পরিবর্তন আসে। আগেই বলে রাখা উচিত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়া ও চীনের চলমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার আলোকেই বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামোর কেন্দ্রীয় অংশ আবর্তিত হয়। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব ভূমিকা পালনে চীন ও রাশিয়ার সম্মিলিত পরিকল্পনার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমেই ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কের মৃদু অস্থিতিশীলতা দূর করার উদ্যোগ নিয়ে সাফল্য পায়। কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র- ইউরোপ সম্পর্ক দৃঢ়তর করার সব পদক্ষেপই রুশ ইউরোপ মৈত্রীর নতুন সম্ভাবনাময় পথটি প্রায় অকার্যকর করে। এমন পরিস্থিতিতে আবার আরব বসন্তের প্রতিক্রিয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের সর্বশেষ সমীকরণে রুশ আধিপত্য বৃদ্ধি করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রও ভিন্ন প্রক্রিয়ায় তার স্বার্থ অক্ষুণœ রাখে। এটা সম্ভব হয়েছে ছয়বিশ্ব শক্তির সঙ্গে ইরানের পরমাণু চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার ফলে। মূলত ওই চুক্তির ফলাফল ইরানের পক্ষ থেকে আসা হুমকি শিথিল করেছে। এদিকে পরমাণু চুক্তি উত্তর পরিস্থিতি ইরানের জাতীয় স্বার্থকেও আগের চেয়ে বেশি নিরপদ করেছে। মধ্যপ্রাচ্য সমীকরণে সব পক্ষের এই ভারসাম্য শেষ পর্যন্ত কারা লাভবান হবেন তা এখনই পরিষ্কার করে বলা যাচ্ছে না। তবে বৈশ্বিক রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণে মধ্যপ্রাচ্য গুরুত্বপূর্ণ। আর সর্বশেষ সমীকরণ বৃহৎভাবে মার্কিনিদের অনুকূলেই আছে বলা যায়।। যদিও ইরান-ইসরায়েল সম্পর্কের ভবিষ্যতের ওপরই নির্ভর করছে মধ্যপ্রাচ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতি। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, ‘যদি ইসরায়েলের ভূ-রাজনৈতিক

আকাক্সক্ষা পূরণ হয়। যদি ইরানের পক্ষ থেকে আসা

হুমকি শিথিল হয়। যদি সিরিয়ায় রেজিম চেঞ্জ পরিকল্পনা থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে আসে। যদি রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক

সংঘাত পরিহার করা যায়। যদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে অবশিষ্ট আরব দেশগুলোর ভূ-রাজনৈতিক বিভাজন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। যদি সৌদি রাজতন্ত্রের চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকেÑতাহলে বলা যায় যে ওই অঞ্চলে রুশ মার্কিন স্বার্থগত সহাবস্থান আপাতত সম্ভব হবে।’ আবার সম্প্রতি জেরুজালেম ইস্যুতে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ সম্প্রসারণের আশঙ্কা আছে। পাশাপাশি ইসরায়েলের রাজনৈতিক ও সামরিক কর্তিত্ব মধ্যপ্রাচ্য

তথা ভূ-মধ্যসাগরীয় এলাকার সীমানা ছাড়িয়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এমনটি সম্ভব হলে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় তার মূল শক্তি মোতায়েন করতে মনোনিবেশ দৃঢ় করবে।

মূলত এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চীনের অব্যাহত অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এশিয়া প্যাসিফিকে চীনের স্বার্থের সম্প্রসারণ ঠেকিয়ে দেওয়া সম্ভব হলে বিশ্বব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা সহজ হবে আমেরিকার জন্য। সঙ্গত কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী

রাশিয়ার সঙ্গে নতুন করে বিবাদের সম্ভাবনা কম। এমন পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে আরো কিছুটা সময় দ্বন্দ্ব-সংঘাত অব্যাহত থাকবে বলেই ধরে নেওয়া যায়।

লেখক : বিশ্লেষক (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা)

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist