ইয়াসমীন রীমা

  ০৯ জানুয়ারি, ২০১৮

শিশুশ্রম

ওরা সংখ্যায় বাড়ছে

দরিদ্র দেশে শিশুশ্রম একটি বাস্তবতা। বাংলাদেশে শিশুশ্রম আছে এবং শিশুশ্রম বন্ধের সেøাগানও আছে। কিন্তু নেই শিশুশ্রম নিরসনে বাস্তবভিত্তিক কোনো কর্মপন্থা। শিশুদের শ্রমিক হওয়ার পেছনে একমাত্র কারণ দরিদ্রতা। যে শিশুর বইখাতা নিয়ে স্কুলগৃহে যাওয়ার কথা, তাকে যেতে হয় ওয়ার্কশপে কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কর্মক্ষেত্রে। দেশের বিভিন্ন শহরের আনাচে-কানাচে প্রতিদিন নতুন শিশুরা এসে যোগ দিচ্ছে হরেক রকম পেশায়। কুমিল্লা শহরাঞ্চলে প্রায় ৩০০ ধরনের কাজে এসব শিশুশ্রমিক শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। তবে শিশু অধিকার ফোরামের হিসাব অনুযায়ী সারা দেশে এই সংখ্যা প্রায় ৪৩০ ধরনের কাজে শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ পেশা হচ্ছে বাস-টেম্পো-অটোরিকশার হেলপার হিসেবে কাজ করা। তা ছাড়া আছে লেদ মেশিন, রোল মেশিন, লোহার রড কাটার কাজ, পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকানের কাজ। তার ওপর রয়েছে আইসক্রিম বিক্রি, হোটেল বয়, হকারি, বাসাবাড়িতে গৃহপরিচারক, ইটভাঁটা, মোটরসাইকেল গ্যারেজ, মুটে ফরমায়েশ খাটা, বুট পালিশ করা এবং ফেরি করে চা বিক্রি করার মতো বিভিন্ন অভিনব পেশা।এই শিশুদের মধ্যে শতকরা সাতজনের বয়স ৭ থেকে ১১ বছরের মধ্যে। এ ছাড়া টোকাই শিশুরাও জেলা শহরে ও উপজেলাগুলোয় শিশি-বোতল কাগজ এবং পরিত্যক্ত ভাঙাচোরা জিনিস কুড়ায়। পরে নির্ধারিত ভাঙারি মালের দোকানে সেগুলো বিক্রি করে আয় করে সাত টাকা থেকে ১০ টাকার বেশি নয়। সারাদিন ইট ভেঙে কুমিল্লায় একজন শিশুশ্রমিক মজুরি পায় মাত্র ২৫ টাকা। অথচ পুরুষ ও মহিলা শ্রমিকরা সেখানে যথাক্রমে পাচ্ছে ৬০-৮০ টাকা। গ্যারেজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং হোটেল-রেস্তরাঁয় শিশুশ্রমিকের শ্রম শোষণের মাত্রা সর্বাধিক। কেউ দিনমজুরি করে পায় ১০ টাকা, আবার অনেকে খাবারের বিনিময়ে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা একটানা কাজ করছে।

কুমিল্লার নুনাবাদ বস্তির মাত্র ১৩ বছর বয়সী মনির একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মতো কাজ করছে। সম্পূর্ণ একটি সংসারের ঘানি টানে সে। তিন বছর আগে বই-খাতা ফেলে কোমল হাতে তুলে নেয় লোহার হাতুরি আর ওয়েডিং মেশিন। লেদমেশিন চালানোর মতো শক্তি দেহে নেই বলে ঝালাই করা আর লোহা পেটানো তার মূল কাজ। কুমিল্লা শাসনগাছা বাসস্টেশনসংলগ্ন কমবেশি ৩০টি ওয়ার্কশপের সর্বকনিষ্ঠ শ্রমিক হিসেবে এখন সহকর্মীদের বাহবা পায় মনির। বাবা-মা চার ভাই ও এক বোনের সংসারে তার উপার্জিত অর্থও গণনায় ধরতে হয়। হাত দিয়ে তার মাথা থেকে আরেকটু উঁচুতে ধরে জানায় বড় ভাই এতটুকু বড়। সেও কাজ করে এক দর্জির দোকানে। দুভাই টাকা না দিলে পঙ্গু রিকশা মিস্ত্রি বাবা একা সংসার চালাতে পারে না। বাকি ভাই-বোন বেশি ছোট বলে তারা ‘কামাই’ করতে পারে না। সে নিজেও অনেক ছোট, প্রশ্ন করাতে বেশ গর্বিত ভঙ্গিতে হাসতে থাকে। হাসির ফাঁকে এসে যোগ দেয় তারই বন্ধু পারভেজ। বলে, স্কুলের স্যারের হাতে প্রতিদিন বেতের বাড়ি খাওয়ার চেয়ে কাজ করা অনেক ভালো। এ বোধ থেকে দুবছর আগে এক গ্যারেজে পেটেভাতে কাজ নিয়েছিল মনির।

রাশেল হোসেন রুবেল বয়স ১৩। কুমিল্লা বাদুরতলা পাবন অ্যালুমনিয়াম ফ্যাক্টরিতে হাঁড়ি-পাতিল বানানোর কাজ করে। ওস্তাদ জহিরুল ইসলাম অ্যাসিডের কাজগুলো রুবেলের বয়সীদের কারিগর দিয়ে করান। প্রায় দুই বছর ধরে এ কাজ করছে। ফলে প্রায়দিনই তার শ্বাস কষ্ট হয় এবং কাশিতে বুক ব্যথা করে। রুবেল বলে, এ কাজ করতে সে নারাজ। কিন্তু তার বাবা এতে রাজি হয় না। কারণ নতুন কাজে মজুরি কম। সকাল ৭টায় বাড়ি থেকে বের হয়। আর কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে রাত ৯টা-১০টা বেজে যায়। মনির জানায়, নুনাবাদ বস্তিতে ৭০০ টাকায় ছোট্ট দুটি কোঠা ভাড়া নিয়ে তারা থাকে। কোঠা দুটি পরিসরে বড় বিধায় তাদের কোনো সমস্যা হয় না। স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে মনিরের এখন বেশ অনাগ্রহ। তাই মনির আশায় বুক বাঁধে। প্রতি মাসে ১০০ টাকা নিজের গোপন জায়গায় জমিয়ে রাখে। দুবছর এই জামা করা টাকা বৃদ্ধি হবে। তার ইচ্ছে সে পুঁজি খাটিয়ে নিজেই একটি পান-বিড়ির দোকান নয়তো পাশের মজিব আলীর মতো ভাঙা০ি ব্যবসা ফেঁদে বসবে। তবে মনির এখন জানে, পরিশ্রমের চেয়ে অনেক কম পারিশ্রমিক পায় সে। কিন্তু তার প্রতিবাদ করার সাহস নেই। কারণ প্রতিবাদ করতে গেলেই তাকে এ কাজ ছেড়ে রিকশা চালাতে হবে। তার মনে ভয়, হারাতে হবে প্রতিদিনের রোজগার ৩০ টাকা। মাসে ৯০০ টাকা। আর রিকশা চালানো শিখতে গেলে প্রতি ঘণ্টায় ছয় টাকা দরকার। উপরন্তু লাইসেন্স খরচ, বড় গাড়ির নিচে চাপা পড়ার ভয় তাকে আরো শঙ্কিত করে।

কুমিল্লা শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে বিসিক শিল্পনগরী এলাকার পাশে গড়ে উঠেছে নুনাবাদ বস্তি। দরিদ্র পরিবারের ঘনবসতি পরিপূর্ণ এ বস্তির অধিকাংশ কিশোর-কিশোরী শিক্ষা সুবিধাবঞ্চিত। অভাবী পরিবারগুলোর জীবনযুদ্ধের সঙ্গে শিশু-কিশোররা জড়িয়ে পড়েছে। যে বয়সে তাদের বই হাতে স্কুলে যাওয়ার কথা সে বয়সে ভোরের আলো না ফুটতেই তার ছুটে যায় নিজের কাজে। ক্রমেই এদের সংখ্যা বাড়ছে। এটাই বাস্তবতা। প্রশ্ন হচ্ছে, এ বাস্তবতা থেকে কখনোই কি আমরা সরে আসতে পারব না!

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist