অলোক আচার্য

  ০৯ জানুয়ারি, ২০১৮

মতামত

বই উৎসবের একাল-সেকাল

বছরের শুরুতেই নতুন বই পৌঁছে গেছে দেশের প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সব ছাত্রছাত্রীর হাতে। এই কোটি কোটি ছাত্রছাত্রী একদিনে হাসিমুখ নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। এর থেকে ভালো শুরু একটি দেশে আর কী হতে পারে। চমৎকার একটি উৎসবের মধ্য দিয়ে কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে নতুন বছর শুরু হয়। বলা যেতে পারে এর থেকে নির্মল হাসির উৎস আর দ্বিতীয়টি নেই। ছোট ছোট কোমলমতি ছাত্রছাত্রীর হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার আনন্দ অনুভব করতে পারেন শিক্ষকরা। যে বিপুল আগ্রহ নিয়ে ওরা নতুন বইয়ের জন্য অপেক্ষা করে তার তুলনা যেন আর কিছুতেই হয় না। এই আনন্দের, উৎসাহের সত্যিই কোনো তুলনা করা যায় না। সন্তান যখন নতুন বই নিয়ে খুশি মনে বাড়ি ফেরে, তখন সেই খুশি স্পর্শ করে তার অভিভাবককে। হাসি ফোটে তার মুখেও। বার্ষিক পরীক্ষার পর থেকেই দেশের কোটি কোটি কচিমুখ অপেক্ষা করে থাকে নতুন বইয়ের জন্য। কোনো হতদরিদ্র পরিবারের শিশুর মুখে এই চিন্তা থাকে না যে বছরের শুরুতেই তাকে বই কিনতে হবে। অথবা তার অভিভাবকের মুখেও চিন্তার কোনো ভাঁজ থাকে না যে, সন্তানের নতুন বইয়ের জোগান তিনি কীভাবে দেবেন। বিনামূল্যে বই দেওয়ার এ সময়ের আগেও ছাত্রছাত্রীরা বছরের প্রথমে বই পেয়েছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা নতুন নয় পুরোনো। গত বছরের ওপরের ক্লাসের ব্যবহার করা কোনো ছাত্রছাত্রীর বই। আমাদের সময়ের কথাই যদি বলি। এখনকার মতোই বার্ষিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হতো। আর আমরা দুশ্চিন্তায় কাটাতাম যে নতুন বই পড়তে পারব তো। কারণ ফল প্রকাশের পর পরই আশপাশের বইয়ের দোকানগুলোয় বই কিনতে রীতিমতো হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। এখনকার ছাত্রছাত্রীদের কাছে বিষয়টা রীতিমতো অবাক করার। একসময় এই ঘটনা কেবল গল্পের মতো মনে হবে। যারা তুলনামূলকভাবে পয়সাওয়ালা তাদের সন্তানদের তেমন কোনো সমস্যা হতো না। কিন্তু যাদের নতুন বই কেনার সামর্থ্য থাকত না তারা পুরোনো বই দিয়েই বছর শুরু করত। এমন হতো যে, দু-তিনটি নতুন বই বহু কষ্টে কিনে দিতে পারলেও অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর প্রথম দু-তিন মাস সেই দুই তিনটি নতুন বই দিয়েই কেটে যেত। সবগুলো নতুন বই পেতে অনেকেই বছরের অর্ধেক সময় অপেক্ষা করেছে। আর কেবল বই কিনলেই চলত না। বইয়ের থেকেও গাইড-নোট কেনার দরকার বেশি ছিল! কারণ তখন তো এমন সৃজনশীল প্রশ্ন ছিল না। ছিল মুখস্থভিত্তিক প্রশ্ন পদ্ধতি। নোট থেকে পুরো কতক প্রশ্ন মুখস্থ করে নিলেই কাজ শেষ। তাই গাইড-নোট কেনার দরকারও ছিল। একে নতুন বই তারপর আবার নোটবই কেনার প্রয়োজন। অভিভাবককে রীতিমতো হিমশিম খেতে হতো। আমার মতো যাদের নতুন বই কেনার সামর্থ্য ছিল না তারা আশপাশের ওপর ক্লাসের বই মাস দুয়েক আগেই বলে কয়ে রাখতাম। এই পুরোনো বইও আবার নতুন বইয়ের এক-তৃতীয়াংশ দাম দিয়ে কিনতে হতো। তবে পুরোনো হলেও আমাদের কাছে তা ছিল নতুন। আর সেই বইয়ের আকর্ষণ আজকের নতুন বইয়ের থেকে কম ছিল না। আজকের এ সময়ের সঙ্গে সে সময়ের কত পার্থক্য। এদিক থেকে আজকে একটি শিশু আমদের থেকে অনেক সৌভাগ্যবান। প্রতি বছর অন্তত সে নতুন বই হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারে। তাকে সেই বই কেনার জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয় না। সেকালেও বই উৎসব হতো। তবে একালের সঙ্গে তার বিস্তর ব্যবধান।

নতুন বই নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা বাড়ি ফিরেছে। এরপর যা ঘটবে তা মোটামুটি কল্পনা করতে পারি। অভিভাভকরা উঠে পড়ে লাগবেন যাতে তার সন্তান সারাদিন লেখাপড়ায় ব্যস্ত থাকতে হবে। পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারে। আর ভালো ফল মানে জিপিএ-৫ পাওয়া। নতুন বইয়ের গন্ধ ভালোভাবে নিতে না নিতেই সেই অনুভূতি মিলিয়ে যাবে। তারা বই ফেলে নতুন নতুন নোট-গাইড কিনবে। তারপর সেই নোট-গাইড নিয়ে তার টিউটরের কাছে দৌড়াবে। কারণ বইয়ের থেকেও ছাত্রছাত্রীদের কাছে গাইডের পেছনে সময় দিতে হয় বেশি। প্রাইভেট আর কোচিং সেন্টারে দৌড়াতেই তাদের ঘাম বেরিয়ে যাবে। সন্তানের মেধা যে পথে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায় বা পূর্ণতা লাভ করে সে পথেই তার প্রকৃত মঙ্গল রয়েছে। বাকি পথ কেবল জোর-জবরদস্তির। কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ফেল করলেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। বরং অন্য কোনো বিষয়ে তার আগ্রহ আছে ধরে নিতে হবে। কোনো নির্দিষ্ট পরীক্ষায় ফেল বা কম মার্ক পেলেই জীবনের সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। জীবনের সাফল্য, ব্যর্থতা নির্ভর করে মনুষ্যত্ব অর্জনে। আর তাই যারা পরীক্ষায় ফেল করেছে বা আশানুরূপ ফল করতে পারেনি তারা যেন সব শেষ হয়ে গেছে এটা মনে না করে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সঙ্গ দিতে পারে সন্তানের অভিভাবক। শেষ পর্যন্ত যদি কোনো ছাত্রছাত্রী পাস না করতে পারে তার জন্য প্রচলিত সংস্কৃতি অনুসারে তার ফেল করার কারণ উদ্ঘাটন করতে ব্যস্ত না হয়ে তাকে বোঝানো যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত তো সে অবশ্যই জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। জীবনযুদ্ধের পরীক্ষার মতো কঠিন পরীক্ষা আর কী আছে। পাস করাটাকে আমরা যত সহজে প্রচার করি ফেল করাটাকে গ্রহণ করার মনমানসিকতা আজও গড়ে ওঠেনি। যার কারণে একেবারেই অর্থহীনভাবে কয়েকটি জীবন প্রত্যেক পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরই ঝরে যায়। এই মনোরোগ থেকে অভিভাবকদের নিজের এবং সন্তানকে বের করে আনতেই হবে। নতুন বই পাওয়ার মাত্র কয়েক দিন অতিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যেই নিশ্চয়ই অনেক অভিভাবক সন্তানকে বলতে শুরু করেছেন তাদের অবশ্যই সামনের পিইসি অথবা জেএসসি অথবা এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেতে হবে। খালি খালি জিপিএ-৫ হলে চলবে না সঙ্গে গোল্ডেন থাকতে হবে। তার জন্য দিনরাত এক করে ফেলতে হলেও কোনো সমস্যা নেই। সব খেলাধুলা বন্ধ। টিভি দেখা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কোন অনুষ্ঠান দেখা উচিত আর কোন অনুষ্ঠান দেখা উচিত না তা ঠিক করা হয়ে গেছে। আমার এসব কোনো বিষয় নিয়েই আপত্তি নেই। তবে অভিভাবকের স্বপ্নপূরণ করতে গিয়ে সন্তানের স্বপ্ন যেন নষ্ট না হয় তার দিকে একটু লক্ষ রাখা উচিত। নতুন বইয়ের গন্ধটা ভালো করে নিতে দেই। গাইডবই থেকে একটু দূরে থাকি। আর প্রাইভেট অথবা কোচিংয়ের চাপ থেকে সন্তানকে দম নেওয়ার সময়টা দেই। তাহলে অন্তত সন্তানের ওপর থেকে চাপ একটু কমবে। তবে আমাদের সময়টাতে অন্তত এই চাপটা এত প্রকট ছিল না। ভালো ফলাফলের আশা সব সময়ই ছিল তবে সারা বছর চাপ ছিল না। জিপিএ-৫ ছিল না তবে বিভাগ ছিল। কিন্তু সেই বিভাগ পাওয়ার জন্য সন্তানকে রোবট সাজতে হতো না।

এরপরেও কথা থেকে যায়। সরকারতো সরকারের কাজ করেছেন। কিন্তু একটন দুধের মধ্যে একফোঁটা চনা ফেলল কে! বইয়ের প্রডাকশন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাতে দেওয়ার মতো হয় নি। নানা ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতির খবর পাওয়া গেছে। যারা এ কাজ করুক না কেন দায়টা সরকারের কাঁধেই গিয়ে পড়ছে। কিন্তু সরকার এ দায় কেন বহন করবে? অন্যায় বা অনৈতিক এ কর্মটি যিনি বা যারা করেছেনÑদায় তাদেরকেই নিতে হবে এবং রাষ্ট্র তা পর্যবেক্ষণ করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবে। এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ঊসধরষ-ংড়ঢ়হরষ.ৎড়ু@মসধরষ.পড়স

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist