এস এম মুকুল

  ০৯ জানুয়ারি, ২০১৮

সময়ের চোরাবালি

চুরি হয়ে যাচ্ছে শৈশব

সকালে গভীর ঘুম থেকে একটা শিশুকে টেনেহিঁচড়ে তুলে ধরিয়ে দেওয়া হয় টুথব্রাশ। ঘুমঘোরে আচ্ছন্ন শিশুটির অনিচ্ছাকে তাচ্ছিল্য করে পরিয়ে দেওয়া হয় স্কুল ড্রেস। তারপর সকালের অরুচিমুখেÑএটা খাও, ওটা খাও। খেতে তোমাকে হবেই। অনিচ্ছাকে বাধ্যবাধকতার শেকল পরিয়ে শিশুটির কাঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় বইয়ের বিশাল ব্যাগ। এরপর পোলট্রি ফার্মের মুরগির মতো ভ্যানগাড়িতে চড়ে বস অথবা বাসে, রিকশায় কিংবা মোটরসাইকেলে বা হেঁটে চল। স্কুলে গিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওঠ। ক্লাসে পড় আর পড়। ছুটি শেষে একগাদা হোমওয়ার্ক নিয়ে বাড়ি এসো। তারপর চার দেয়ালের বন্দিশালায় কর হোমওয়ার্ক। বিকেলে আসবেন হোম টিউটর। সপ্তাহে যেতে হবে গানের স্কুলে। শিখতে হবে নাচ বা আবৃত্তি। ড্রয়িংটাও কেন বাদ যাবে। শিখে নিতে হবে ধর্মীয় চর্চার বুনিয়াদি শিক্ষা। উফ্ কী অমানবিক, নির্মম নির্যাতন! ওদের দেখে কষ্টে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে। হায় কপাল, জাতির ইচ্ছের বোঝা যেন অবুঝ একটি শিশুর কাঁধে।

ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। সকালে হাত-মুখ ধুয়ে আঙিনায় গলাছেড়ে পড়তামÑ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই’। ৮টায় গোসল করে খেয়ে-দেয়ে দল বেঁধে হই-হল্লা করে ছুটে যেতাম স্কুলে। সেখানেও কিচ্ছুক্ষণ হইচই, রইরই। ক্লাস শেষে স্কুল ছুটি গরম গরম রুটি ও উত্তাপ নিয়ে বাড়ি ফেরা। তারপর সারাদিন খেলাধুলা হই-হল্লা। সন্ধ্যায় মাগরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গে অজু করে নামাজ শেষে পড়তে বসা। কত না আনন্দে কেটেছে শৈশব।

কী পাচ্ছে একালের শিশুরা! যে শিশুটি ঠিকমতো কথা বলতেও শিখেনিÑতাকে দেওয়া হচ্ছে স্কুলে। ক্লাস ওয়ানের বাচ্চাটিকে শেখানো হচ্ছে ইংরেজি রি-অ্যারেঞ্জ! বাবা-মা ব্যস্তÑব্যস্ত সবাই। শিশুটির সঙ্গে সময় কাটানোর সময় কারো নেই। তার সাথি গেম আর কার্টুন। অথবা যদি বাসায় থাকে কাজের লোক। আহারে একালের শৈশবে কী নিদারুণ, নিঠুর-নির্মম-নির্যাতন চালানো হচ্ছে অহেতুক, কারণে-অকারণে।

এভাবে স্কুল, কোচিং, হোমওয়ার্ক, হোমটিচার আর ভালো রেজাল্ট করার অবিরত অসহনীয় চাপে পিষ্ট হচ্ছে একালের শৈশব। যেখানে প্রকৃতির আলিঙ্গন নেই, আকাশ দেখার সুযোগ নেই, খোলা মাঠ নেই, পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে হই-হল্লার সুযোগ নেইÑআছে শুধু শাসন আর বেঁধে দেওয়া সময়ের, ‘পড়ো, নাও-খাও আর ঘুমাও মার্কা শৈশব’। এই নগরের ইট-কাঠ কংক্রিটের বাঁধনে আটকে গেছে এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের শৈশব-কৈশোর। উন্মুক্ত মাঠে খেলাধুলা করতে না পারায় শিশুরা শারীরিকভাবে অলস হচ্ছে। মুটিয়ে যাচ্ছে শিশু-কিশোররা, শরীরে বাসা বাঁধছে নানা রোগ। শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি সঠিকভাবে হচ্ছে না। বন্দিত্বের কারণে খিটখিটে মেজাজের হচ্ছে শিশুরা। একালের বাবা-মায়েরাও শিক্ষা বণিকদের ফাঁদে পড়ে হারিয়ে ফেলছে খেই। তারাও বোঝার চেষ্টা করছেন নাÑওরা শিশু, কোমল ওদের দেহ ও মন। ওরা রোবট নয়। ফেসবুক, ইন্টারনেট, মুঠোফোন, ডিস-এন্টেনার তারে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রিয় মুহূর্তগুলো। বিভিন্ন গবেষণা বলছেÑঢাকা-কলকাতার মতো শহরের কংক্রিটের জঙ্গলে অনেক শিশু মাটির সংস্পর্শে আসতে পারছে না। অথচ জার্মানিতে শিশুদের প্রকৃতির কোলে যেতে উৎসাহ দেওয়া হয়। সেখানে জঙ্গলের ভেতর গড়ে উঠেছে কিন্ডারগার্টেন। গাছপালা ও নানা প্রাণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ-পরিচয় হয় তাদের। যদি সেকালের কথা বলিÑভালো-মন্দের প্রভেদ চেনা, কল্যাণ চিন্তা, প্রগতি ভাবনা, মানবিকতায় আর্র্দ্র হওয়ার মন্ত্রণা আমরা পেয়েছি সেই শৈশব-কৈশোরে। সেকালের অভাবের সঙ্গে সখ্যময় গ্রামীণ জীবন থেকে বেড়ে উঠে কেউ হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় ছাত্র, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসক আরো কত কিছু। আর একালের বাবা-মাও যেন জন্মের পরই ঠিক করে নেন তার সন্তানকে কী বানাবেন!

দুঃখ লাগে, আমাদের সন্তানদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দুরন্ত শৈশবের গল্প। আমাদের শহুরে সন্তানরা মাছের নাম জানলেও, সেই মাছটি চেনে না। ফল খায় তবে ফলের গাছ চেনে না। গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকার কারণে এরা গাছে চড়তে জানে না। তারা সাঁতার জানে না। কালবৈশাখীর ঝড় কী জিনিস তা সে গ্রামে না গেলে কী করে বুঝবে। কৃষকের কৃষিকাজের নৈপুণ্যতা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ দিতে হবে। আর এসবের জন্য কাব্যকথার সেই গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। চীনের উদ্যোগটি অনুসরণীয়। গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে ধারণা নিতে এবং জীবনযাত্রার পার্থক্য অনুধাবনের জন্য চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় চংকিং শহর কর্তৃপক্ষ শহরের শিক্ষার্থীদের গ্রামে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের মতে, এর ফলে প্রজন্মগত ও ভৌগোলিক দূরত্ব কমানো সম্ভব হবে। তারা ব্যয়বহুল-অভিজাত জীবনযাপনের পাশাপাশি গ্রামীণ জীবন সংগ্রাম এবং তাদের বাবা-মা-স্বজন-সহোদর ও পূর্বপুরুষদের জীবনযুদ্ধ সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পাবে। তাদের ধারণাÑ এসব শিক্ষার্থীর জীবনবোধ হবে মানবীয়। তারা জীবনের কঠিন সংগ্রামকে শক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে পরিশ্রম করে জয় করতে সমর্থ হবে। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনকি সরকার ও এনজিওদের পৃষ্ঠপোষকতায় স্কুল, কলেজপর্যায়েও চীনের মতো এমন ইন্টার্নশিপ প্রশিক্ষণ কোর্স সিলেবাসের আওতায় নিয়ে আসা দরকার। তাহলেই পরিবর্তন আসবে। জীবন বোধ, পারিবারিক সম্পর্ক ও দেশীয় সংস্কৃতিতে উজ্জীবিত হয়ে উঠবে আমাদের আদরের সন্তানরা।

আমাদের পারিবারিক, সামাজিক এবং শিক্ষাজীবনে মানবিকতার বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ খুবই জরুরি। আমাদের সন্তানদের দান করতে শেখানো। সহমর্মী এবং সহযোগী হতে শেখানোর বুনিয়াদি শিক্ষা পরিবার থেকেই পেতে হবে। তবে তা শিক্ষা কারিকুলামেও থাকা আবশ্যক। পাশাপাশি সামাজিক সম্পর্কগুলোও বাড়ানো দরকার। এই আধুনিক ফ্ল্যাট কালচারের অদ্ভুত এক সভ্যতা বিরাজ করছে। কেউ কারো খবর রাখে না। যাওয়া-আসা হয় না। ফ্ল্যাটের বাসিন্দা ছোট্টমণিরা একসঙ্গে খেলতে পারে না। গল্প ও আড্ডায় মেতে উঠতে পারে না। কেমন যেন একটা রিজার্ভ সংস্কৃতির কবলে একক পরিবারের একাকিত্ব পেয়ে বসেছে আমাদের সন্তানদের জীবনে। এই শেকল ভাঙতেই হবে। এই রেওয়াজ বদলাতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। বাসায় বাসায়, ঘরে ঘরে সহপাঠী ও খেলার সাথি বন্ধুদের জম্পেস আড্ডার সুযোগ না থাকলে ওদের বোধের পরিব্যাপ্তি বাড়বে না। অভিজ্ঞতা বিনিময় না হলে ওদের মনন ও জ্ঞানের জগৎ বড় হবে না। মানবিক সম্পর্ক তৈরি হবে না। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে তাদের সৃজনশীলতা দৃষ্টান্ত উপহার হিসেবে দিতে পারবে না।

দুঃখজনক সত্যি হলোÑআমাদের পারিবারিক বিনোদনের জায়গাগুলো ছোট হয়ে আসছে। বাবা-মা, ভাই-বোন মিলে একসঙ্গে টিভির অনুষ্ঠান দেখা হয় না। যাওয়া হয় না সিনেমা হলে। সেখানে নেই পরিবেশ। নেই ভালো সামাজিক ছবি। তার পরও কিন্তু কিছু কিছু ছবি ভালো হচ্ছে। কিন্তু সন্তানদের নিয়ে দেশীয় সংস্কৃতির এসব বিনোদন শেয়ার করা হচ্ছে না। যাওয়া হয় না নাট্যমঞ্চে। পারিবারিক ভ্রমণব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা তো আছেই। আত্মীয়দের বাসায় দাওয়াত খেতে যাওয়া এবং তাদের দাওয়াত খাওয়ানোর রেওয়াজটাও আধুনিকতার নামে চায়নিজ রেস্টুরেন্টে আটকে গেছে। এ কারণে আত্মীয়তার সামাজিক বন্ধনগুলো কাছে টানছে না সন্তানদের জীবনকে। পারিবারিক বন্ধনগুলো ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন সংস্কৃতির নেতিবাচক দিকগুলোর অনুপ্রবেশ ঘটেছে বাংলাদেশের আবহমান সংস্কৃতিতে। অভিভাবকরা সন্তানদের ভাষা বুঝতে পারছেন না। তারা অনেক সময় সন্তানের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করছেন না, আলাপ-আলোচনায় সহনশীলতার পরিচয় দিচ্ছেন না। সন্তানের সঙ্গে অভিভাবকের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। আবার সন্তানরাও অভিভাবকদের প্রত্যাশার কথা আমলে নিতে চাচ্ছে না। তাহলে কেমন হবে ভবিষ্যৎ? আন্তর্জাতিক শিশু সাহায্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের ‘চুরি হয়ে যাওয়া শৈশব’-বিষয়ক এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, বিশ্বে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন বা তারও বেশি শিশুর শৈশব নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই বাস্তবতা বাংলাদেশে চরম পর্যায়ে। এখানে চলছে সন্তানকে জোরজবরদস্তি করে কিছু একটা বানানোর অসম প্রতিযোগিতা। শহরের শিশুদের খেলার জায়গা নেই, তাই শিশুরা মুঠোফোন গেমসে আসক্ত হয়ে পড়ছে। মার্কিন জার্নাল ‘পেডিয়াট্রিক্স’-এ প্রকাশিত একটি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব শিশু প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিভি দেখে বা কম্পিউটারে খেলার জন্য স্ক্রিনের সামনে বসে থাকে, তারা অন্য শিশু যারা এসব করে না তাদের চেয়ে মনস্তাত্ত্বিকভাবে বেশি সমস্যায় ভোগে। তারা বেশি আবেগপ্রবণ হয় তাই তাদের সবকিছুই অতিরিক্ত পর্যায়ে চলে যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে স্মার্টফোন, আইফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ, ডিজিটাল ক্যামেরার প্রতি বড়দের দেখে শিশুদেরও আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে। শিশুদের স্ক্রিন আসক্তি নিয়ে ‘গ্লো কিডস : হাউ স্ক্রিন এডিকশন ইস হাইজেকিং আওয়ার কিডস অ্যান্ড হাউ টু ব্রেক দ্য ট্রেন্স’ নামে বই লিখেছেন মার্কিন সাইকোথেরাপিস্ট ও আসক্তি বিশেষজ্ঞ ড. নিকোলাস কারদারাস। তিনি স্ক্রিন এডিকশনকে ‘নতুন শতাব্দীর মাদক’ বলে উল্লেখ করেছেন।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

ৎিরঃবঃড়সঁশঁষ৩৬@মসধরষ.পড়স

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist