হিমেল আহমেদ
পরিবেশ
দূষণ : শীর্ষে বাংলাদেশ
যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেটের জরিপ অনুযায়ী বিশ্বে দূষণের কারণে মৃত্যুর সংখ্যার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। ল্যানসেটের তথ্যানুযায়ী, ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাপী ৯০ লাখ মানুষ দূষণের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ মৃত্যু ঘটেছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোয়, যেখানে এক-চতুর্থাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ ছিল দূষণজনিত। আর দূষণ থেকে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে বাংলাদেশে। যার অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে ধরা হচ্ছে অধিক জনসংখ্যা। বাংলাদেশ আয়তন অনুযায়ী অতিরিক্ত জনসংখ্যা বহন করছে, যার ফলে ক্রমে ক্রমে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে দেশটি! বাড়তি জনসংখ্যাকে সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে পরিবেশ। ফলে বাড়ছে বায়ু ও পানিদূষণ। বিজ্ঞানীরা এই দুই দূষণকেই দায়ী করছেন। যার কারণে মৃত্যুর হার আজ এত বেশি! ল্যানসেটের জরিপে উঠে আসা এই তথ্যটি স্বাভাবিক; কেননা বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশে জন্মহার পরিলক্ষিত করে অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, অতিরিক্ত জনসংখ্যা বাংলাদেশকে বড় বিপদে ফেলবে! বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম। ২০৫০ সালে দেশের জনসংখ্যা ২০০১ সালের তুলনায় দ্বিগুণ হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরমুখী জনশক্তির সংখ্যা বাড়ছে, বিশেষ করে বাণিজ্যিক শহরগুলোতে চাপ অনেক বেশি। অতিরিক্ত লোকবলের জন্য অতিরিক্ত কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে হচ্ছে, যার ফলে নদী, খাল, বিল ভরাট করে তৈরি করা হচ্ছে কলকারখানা। জীবনযাত্রা উন্নত হচ্ছে ক্রমেই। তার সঙ্গে বাড়ছে শহরে যানবাহনের সংখ্যাও। রাজধানী ঢাকার কথাই বলি; ঢাকাকে বলা হয় ‘মসজিদের শহর’। অনেকে বলেন, জাদুর শহর। কিন্তু বর্তমানে সে চিত্র পুরোটাই উল্টো!
ঢাকা এখন শুধু মানুষ আর ধুলো ময়লার শহর। যতক্ষণ মানুষ থাকে রাস্তায় ততক্ষণ ময়লা চোখে পড়ে না। মানুষ কমে এলেই বেরিয়ে আসে ময়লা। কেউ কেউ বলেছেন, স্বাধীনভাবে প্র¯্রাব করার শহরের নামও ঢাকা। আইল্যান্ডের চিপায়, ওভারব্রিজের নিচে, ফ্লাইওভারের নির্জনে সুযোগ পেলেই হিসুরত মানুষ চোখে পড়ে। নির্লজ্জ মানুষের শহর ঢাকা। শব্দ আর মাস্তানির শহর ঢাকা। জোরে কথা বলার, হর্ন দেওয়ার শহর ঢাকা। শিশুদের জন্য নিষিদ্ধ শহর ঢাকা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘হেলথ এফেক্টস ইনস্টিটিউট’ এবং ‘ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন’-এর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত বৈশ্বিক বায়ুদূষণ পরিস্থিতি-২০১৭ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ঢাকা দূষণে মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ত্রুটিপূর্ণ বাস, বেবিট্যাক্সি, রিকন্ডিশন্ড গাড়ি এবং বিক্ষিপ্তভাবে স্থাপিত কাগজ, পাট ও টেক্সটাইল কারখানা থেকে অবিরাম পরিবেশ বিনষ্টকারী কালো ধোঁয়া ও বিষাক্ত রাসায়নিক বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। যানবাহন ও কলকারখানার অনিয়ন্ত্রিত কালোধোঁয়া বাতাসে সবচেয়ে বেশি কার্বন-মনোক্সাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাসের বিস্তার ঘটায়। এসব উৎস থেকে সৃষ্ট মিথেন, ইথেলিন বাতাসে মিশ্রিত হয়ে প্রাণী দেহে ভীষণ ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
শহরের অনিয়ন্ত্রিত বর্জ্য অপসারণও বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত। কঠিন ও তরল বর্জ্যরে পচন বাতাসে নানারূপ গ্যাসের বিস্তার ঘটিয়ে মানুষসহ ও অন্যান্য প্রাণী এবং উদ্ভিদের জীবননাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্বে প্রতিবছর বায়ু দূষণজনিত রোগে ২০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। বর্তমানে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ, যা সত্যিই উদ্বেগজনক। বায়ুদূষণের সঙ্গে সঙ্গে পানিদূষণও বেড়েছে বাংলাদেশে। এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-১৬ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে তথ্য উঠে এসেছে যে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৪৮টি দেশের মধ্যে নদীর পানি সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে বাংলাদেশে। প্রতিবেদন অনুযায়ী এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর শহর ও শিল্পাঞ্চলের ৮০ শতাংশ পয়ঃবর্জ্য কোনো শোধন ছাড়াই পানিতে ফেলা হয়। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, এর শহর ও শিল্পাঞ্চলের পয়ঃ ও রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি নদী বা জলাশয়েই পতিত হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে, রাজধানীর চারদিক দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো পয়ঃ ও রাসায়নিক বর্জ্যে এতটাই দূষিত হয়ে পড়েছে যে, এসব নদীর পানি অনেক আগেই ব্যবহারের উপযোগিতা হারিয়েছে। নদী, খাল, বিল ভরাট করে দালান তৈরি করা হচ্ছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই আমরা দেখেছি রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামের রাজপথের জলাবদ্ধতা। এসব সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে এখনই। যত দিন যাচ্ছে সংকট আরো প্রকট হচ্ছে। সরকার ও জনসাধারণের এই বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া অতীব জরুরি।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
"