ক্যাম্পাস ডেস্ক

  ১৫ জুন, ২০২০

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার পীঠস্থান

‘প্রভু আমার আলো’Ñ কে নীতিবাক্য হিসেবে বুকে ধারণ করে সেই যে ১০ম শতকে অক্সফোর্ডে উচ্চশিক্ষার কার্যক্রম শুরু হয়, তা হাজার বছর যাবৎ অতীত ঐতিহ্য আর সুনাম যথার্থভাবে ধরে রেখে আজও চলছে। এ সময়ে শত শত রথী-মহারথীর পদচারণায় সর্বদাই মুখরিত ছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। জ্ঞান বিতরণের পাশাপাশি জ্ঞান সৃষ্টি করার মাঝেও অনন্য হয়ে ওঠে এই বিশ্ববিদ্যালয়। একে আদর্শ মেনে নিয়ে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে কত শত বিশ্ববিদ্যালয় তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু সেসবের মাঝে ‘অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়’ নামটি মধ্যগগনের সূর্যের মতোই সর্বোচ্চ তেজে জ্বলজ্বল করছে। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মানুষ একনামে যে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে চেনে, তা হলো এই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়।

যশ আর খ্যাতির চূড়ায় যে বিশ্ববিদ্যালয়টি বসে আছে, তার শুরুর ইতিহাসটি সঠিকভাবে কোথাও লেখা নেই! এ যেন এক চিরন্তন রহস্যেরই নামান্তর। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শুরু হবার লিখিত দলিল পাওয়া যায় ১০৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে। কিন্তু নানা ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এটা নিশ্চিত যে, ১০৯৬ খ্রিস্টাব্দের আরো কিছুকাল পূর্বেই স্থাপিত হয়েছিল এই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকের একজন বিদেশি অধ্যাপক হিসেবে ‘ইমো অব ফ্রিজল্যান্ড’-এর নাম আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই। রাজা তৃতীয় হেনরির আমলে, ১২৪৮ সালে প্রথম রাজকীয় সনদপত্র লাভ করে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়।

১২০৯ খ্রিস্টাব্দে, অক্সফোর্ডের স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ বাধে এবং প্রচ- মারামারি হয়। তখনো অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র শতবর্ষী একটি প্রতিষ্ঠান, সবে নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করেছে। এই সংঘর্ষের ফলে অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী অক্সফোর্ড ত্যাগ করে ক্যামব্রিজ চলে যান, যার সূত্র ধরেই কিছুকাল পর ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে, জ্ঞানচর্চায় অক্সফোর্ডের একাধিপত্যের ইতি টেনে ডুয়োপলির সূচনা করে ক্যামব্রিজ। উচ্চশিক্ষার প্রসারে এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অপরিসীম তা না বললেও চলে। কিন্তু ইংল্যান্ডে নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে জ্ঞান বিকাশের পথকে দীর্ঘকাল প্রসারিত করতে দেয়নি এই দুই প্রতিষ্ঠান। ১৮৩৪ সালে কয়েকজন প-িত মিলে স্ট্যামফোর্ডে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে তারা অক্সফোর্ড এবং ক্যামব্রিজের রোষের মুখে পড়েন। তখন রাজা তৃতীয় হেনরি একটি পিটিশন জারি করে দেন, যার দরুন ১৮২০ সালের আগে ইংল্যান্ডে আর কোনো উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি!

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চা প্রথম কয়েকশ বছর কিছুটা চার্চ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তবে সবকিছু পরিবর্তিত হতে শুরু করে রেনেসাঁর সময়। ১৫৩৪ সালে ‘চার্চ অব ইংল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং শিগগিরই তারা দেশজুড়ে সংস্কারকাজ শুরু করে, যা ‘ইংলিশ রিফর্মেশন’ নামে পরিচিত। এ সময় রোমান ক্যাথলিক চার্চ এবং প্রোটেস্ট্যান্টদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে চার্চ অব ইংল্যান্ডের আওতায় চলে আসে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। এতে অসন্তুষ্ট হয়ে অসংখ্য ‘রিকুজেন্ট’ প-িত এবং শিক্ষার্থী অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন। রিকুজেন্ট বলতে মূলত ক্যাথলিক চার্চের অনুসারী এবং ‘অ্যাংলিকান’ বা ইংরেজ সংস্কারের বিরোধীদের বোঝায়।

সব কিছু মিলিয়ে, ‘এজ অব এনলাইটম্যান্ট’ বা আলোকিত যুগেই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যায়। ক্যাথলিক চার্চে বিশ্বাসী অসংখ্য শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক হারানোর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম নষ্ট হয়। নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির হার অনেক কমে যায়, নেমে যায় পড়ালেখার মানও। তবে এটি ছিল অক্সফোর্ডের জন্য রূপান্তরের সময়। দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে রেনেসাঁর শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করতে কিছুটা সময় লাগা ছিল খুবই স্বাভাবিক।

যাহোক, ১৭ শতকের শুরুর দিকে আবার প্রাণ ফিরে পেতে শুরু করে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। ১৬৩৬ সালে ক্যান্টারবুরির আর্চবিশপ উইলিয়াম লড বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন আইনগুলোর সঙ্গে নতুন নতুন ধারা যোগ করে বিধিবদ্ধ করেন। ১৯ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত তার সে সংবিধানেই চলেছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। লড বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ছাপাখানাটি আরো শক্তিশালী করেন এবং লাইঙ্গ্রেরিগুলোকে উন্নত করেন। তাছাড়া, চার্চ অব ইংল্যান্ডের সাথে সংযুক্ততার কারণে নিয়ম ছিল যে, কোনো ‘ডিসেন্টার’ অক্সফোর্ডে স্নাতকোত্তর পড়ালেখা করতে পারবেন না। এই নিয়ম ১৮৭১ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল। ডিসেন্টার বলতে চার্চ অব ইংল্যান্ডের অননুগামীদের বোঝানো হতো। অন্যদিকে, চার্চ অব ইংল্যান্ডের সদস্য হতে হলে অক্সফোর্ড থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের নিয়ম ছিল।

দর্শনার্থীদের জন্য অক্সফোর্ডের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভবনগুলো হচ্ছে রেডক্লিফ ক্যামেরা, শেলডোনিয়ান স্কুল, ক্রাইস্টচার্চ ক্যাথেড্রাল এবং এক্সামিনেশন স্কুলগুলো। আর শহরজুড়ে ছড়িয়ে আছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৩৮টি কলেজ ও ৬টি হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীরই কোনো না কোনো হল বা কলেজের সদস্য হতে হয়। শিক্ষার্থীদের অবকাশ যাপনের জন্য আছে মোট ৭০ একর পার্ক। রয়েছে অসংখ্য ছোট বড় খেলার মাঠ, বোটানিক্যাল পার্ক, জেনেটিক পার্ক। পার্কগুলো দিনের বেলা দর্শনার্থীদের জন্যও উন্মুক্ত থাকে। খেলার মাঠগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের প্রয়োজনেও ব্যবহার করা হয়।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু জাদুঘর রয়েছে যার মধ্যে অ্যাশমোলিয়ান জাদুঘর সবচেয়ে পুরাতন। ১৬৮৩ সালে এটি স্থাপিত হয়। তাছাড়া ‘ইউনিভার্সিটি মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি’, ‘পিট রিভারস মিউজিয়াম’, ‘মিউজিয়াম অব দ্য হিস্ট্রি অব সায়েন্স’, ‘ক্রাইস্টচার্চ পিকচার গ্যালারি’, প্রতিটি জাদুঘরই ১৯ শতকে স্থাপিত হয়েছে। এসব জাদুঘর দর্শনার্থীদের জন্য দিনের বেলা বিনামূল্যে উন্মুক্ত থাকে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব প্রেস, ‘অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস’ বর্তমান বিশ্বের বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় ছাপাখানা। প্রতিবছর এখান থেকে ৬ হাজার বই, গবেষণা, রেফারেন্স গ্রন্থ এবং অভিধান ছাপা হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close