প্রতীক ইজাজ
সিথান
ঝাঁপির ভিতর থিকা উঁকি দেয় ব্রাহ্মণি দুইমুখা। লাল চোখ সাপুড়ে ফুঁ দেয় বীণে। জলকাদা ভাইঙ্গা কিলবিল ছোটে ছেলেপুলের দল। রুমাল ওড়ে, ঝাঁপি খোলে, পাথরের লাহান শক্ত পেশি ফুইটা ছোটে সাহসের বান। পাশ থিকা গান ধরে মেয়েটিÑ
‘কি সাপে দংশিল লখাই রে...’
একদিন এই জমিতে চিতল মাছের লাহান সাদা বুক নিয়া দাঁড়াই ছিল চাঁদ সওদাগর। সুতানলি সাপের লাহান এক চিলতে রাস্তা আইসা ঠেকছিল বুকের ভেতর বেহুলার। প্রেমতাপে পুড়ছিল লখিন্দর। তখন কি জানত, এই প্রেমসড়ক একসময় দরিয়ার লাহান উথাল-পাথাল শরীর নিয়া আছড়ে পড়ব কালিদহেÑ ভাসান দিয়া বসতভিটা, সওদাগরি নাও ভাসব কলার ভেলায়;
রাত পোহায়, পোড়ে শরীর, ফুল ফোটে, ডালায় ডালায় লকলক বাড়ে পুষ্পিত সুষমা। কামের ফুটা দিয়া একদিন ঢোকে সুতানলি জিব। ছোবল কাটে শরীরে; শরীর নয়, য্যান বিষ ঢালে কালিদহে! ভাসে সুর অচিন আন্ধারেÑ
‘জাগো জাগো কন্যা জাগো
ঘুমাইয়ো না আর
জল কান্দে, কান্দে বন্দর, আর লখিন্দর’
বন্ধ হয় ঝাঁপি, সাপুড়ের খেলা, রঙিন রুমাল ওড়ে বাতাসে। মাটির নিচ থিকা উঁকি দেয় ইতিহাসের কালবেলা। মানুষ ছোটে, হাঁটে, লাল ইটের পাঁজর ছিঁড়া বাইর হইয়া আসে ছেঁড়া প্যান্ট উদ্দাম দুপুরের কিন্নর কণ্ঠÑ
‘রে বিধি কি হইলো রে’
শুনতে শুনতে পিঁপড়ার দঙ্গল সারি সারি মানুষ ছোটে সেই দরিয়ায়। জল নাই, কালিদহ নাই, সওদাগরি নাও সিধায় যায় কলার ভেলায়। বেহুলা নাই, লখিন্দর নাই। তবু প্রেমবাসর রচনা করে মানুষ কিসের আশায়? কার ভরসায়? কোন সে আসমানে চাঁদের লাহান জ্যোৎস্না নিয়া আবার উঁকি দেয় ইতিহাস? এইখানে, এই জমিতে রচে কার কবর?
আমরা তো আছিলাম শাল বৃক্ষের লাহান টানটান বুক নিয়া সাত পুরুষের ভিটার মালিক। যুদ্ধে বাধি নাই; বাধছে যুদ্ধ সিন্দুকে সিন্দুকে। উঁচু ঢিবার চূড়ায় শিঙ্গায় ফুক দিয়া একদিন, একদিন আমরাই দাঁড়ায় ছিলাম মাটির টানে, শক্ত কোমর নিয়া তীর-ধনুকের টানে উড়ায় দিছিলাম শান্তির কবুতর।
আজ আবার ডাক পড়ে, ডাকে কেউ, ডাক পড়ে কালিদহে! সুড়ঙ্গ ফুইরা বের হয় লখিন্দর, সুতানলি বেণি নিয়া বাতাসে বসন ভাসায় বেহুলা। মাথায় ঝাঁপি, অলো-ঢলো প্রসতদারি, ঠোঁটে তার সেই ইতিহাসের বয়ানÑ
‘এই মাটিতেই একদিন আমরা সাতঘর মানুষ ঘুমাইছি এক সিথানে
এখনো ঘুমাই
নিবি যদি আয় আগুন ছোবল!’
"