শিতাংশু গুহ

  ১৫ আগস্ট, ২০১৯

‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো’

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যেই ইমাম সমাহিত করেছিলেন, আশির দশকের মধ্যভাগে তিনি একবার দৈনিক বাংলার বাণীতে এসেছিলেন। সম্পাদক শেখ ফজলুল করিম সেলিম আমাকে ডেকে বলেন তার একটি ইন্টারভিউ নিতে। নিয়েছিলাম এবং তা বাংলার বাণীতে ছাপা হয়েছিল। সম্ভবত হেডিং ছিল, ‘তিনি আমাদেরই লোক’। রাশেদুল হক পাশার হাত দিয়ে সেটি হয়তো একটি বিশেষ সংখ্যায় ছাপা হয়। সেই লেখাটি আমি খুঁজছি। আগস্ট মাস এলেই খুঁজি। কারণ বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহের এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা এবং কবর দেওয়ার ঘটনার তথ্য এখনো আমার অন্যত্র কোথাও চোখে পড়েনি। জাতির পিতা তখনো অবহেলিত। ওই ইন্টারভিউ গুরুত্বহীনভাবে ছাপা হয়েছে। সেটাও হয়তো সম্ভব ছিল বাংলার বাণী বলে। তখনো বাংলার বাণীতে ‘সিঁড়িতে পড়ে থাকা বঙ্গবন্ধু’র লাশের ছবিটি ছাপা হয়নি। এই ছবি ছাপার গল্পটি বলি : মানিক ভাই তখন বাংলার বাণীর বার্তা সম্পাদক। মানিক ভাইয়ের পুরো নাম নাজিমুদ্দিন মানিক। আমরা শিফট ইনচার্জ। নিউজের ব্যাপারে আমাদের যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ওই ছবির বিষয়ে কোনো পাত্তাই ছিল না। বিষয়টি ছিল গোপনীয়। আগে জানাজানি হয়ে গেলে নাও ছাপা হতে পারত? আমরা কানাঘুষা শুনলাম বেশ বড় কোনো ঘটনা ঘটবে বা এমন কিছু পত্রিকায় আসবে যা যুগান্তকারী।

দু-এক দিন এভাবে চলল। সম্ভবত শফিকুল আজিজ মুকুল এবং বাকশালের ফকির রাজ্জাক ভাই বিষয়টি জানতেন। কারণ তারা সবাই তখন শেখ হাসিনার খুব কাছের মানুষ ছিলেন। ছবিটি শেখ হাসিনা দিয়েছিলেন তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়? এমনিতে আমরা গভীর রাত পর্যন্ত অফিসে থাকতাম। সেদিন আমাদের রাত ১১টার দিকে মানিক ভাই বলল, তোমরা বাড়ি যাও। আগে যেতে পেরে আমরা খুশি হলাম। পরদিন পাতাজুড়ে সেই বিখ্যাত ছবি ছাপা হয়, হেডিং ছিল, ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো’। সেদিন বাংলার বাণী অনেক বেশিগুণ বিক্রি হয়েছিল। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর ওই ছবি ছাপা কিছুটা রিস্ক ছিল। শেখ সেলিম সেই ঝুঁকি নিয়েছিলেন। মনে রাখতে হবে, এরশাদের আমলে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। বাংলার বাণী বন্ধ হয়েছিল। সেটি অবশ্য বেশ পরে, কিন্তু ওই ছবি তার গ্রেফতারের একটি অন্যতম কারণ হতে পারে। ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো’ এই উক্তি অতঃপর বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। তখন আরো একটি উক্তি সামনে এসে যায়, তা হলো : ‘জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব অনেক বেশি শক্তিশালী’। আশির দশকে বাংলার বাণী নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধুর পুনরুত্থানে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে।

এখন ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো’ বা ‘জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব অনেক বেশি শক্তিশালী’ সেøাাগান সবাই হরহামেশা বলেন, কিন্তু তখন ‘শেখ মুজিব’ নিষিদ্ধ ছিলেন। তার কথা বলার জন্য কিছুটা সাহসের প্রয়োজন ছিল। উনিশ শ একাশি সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন মুজিব অনুসারীদের সেই সাহস জুগিয়েছিল। শেখ হাসিনার আগমনের দিনটির কথা আমার মনে পড়ে। আমরা অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান স্যারের বাড়ি ‘সংশয়’-এর সামনে দাঁড়িয়ে তাকে দেখেছিলাম। তখন ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছিল। সেই বৃষ্টির মধ্যে রাস্তার দুপাশে লাখো জনতা জানান দেয়, ‘বঙ্গবন্ধু মরে নাই’?

বঙ্গবন্ধু যেদিন ফিরে আসেন সেদিনও আমার সৌভাগ্য হয়েছিল শাহবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে দূর থেকে খোলা জিপে বঙ্গবন্ধুকে দেখার। না, বঙ্গবন্ধুকে একেবারে সামনে থেকে দেখার সৌভাগ্য কখনোই হয়নি। তবে শেখ কামালকে বহুবার দেখেছি। কারণ আমরা তখন ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র। শেখ কামালও তাই। টিএসসিতে তিনি আড্ডা মারতেন। আমরাও আড্ডা মারতাম। তিনি ছাত্রছাত্রীদের সেই জটলায় এসে বসতেন। সবার সঙ্গে বসে চীনাবাদাম খেতেন। তার সঙ্গে আমার কখনো কথা হয়নি। আমি ভাবতাম, প্রেসিডেন্টের পোলা আইসা আমাদের মতো সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে বসছে? তাকে কখনো আর পাঁচটা সাধারণ ছাত্রছাত্রীর চেয়েবেশি কিছু মনে হয়নি। আর সুলতানাকে আমরা প্রত্যেক দিন দেখতাম জগন্নাথ হল থেকে কার্জন হলে যাওয়ার পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে দৌড়াচ্ছে।

এরই মাঝে এসে পড়ে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল। দুদিন আগে খন্দকার মুশতাক টিফিনকারী করে হাঁসের মাংস এনে বঙ্গবন্ধুকে খাইয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বাবা মারা যাওয়ার পর মুশতাক যত কেঁদেছিলেন, সম্ভবত বঙ্গবন্ধুও ততটা কাঁদেননি? অন্তত টিভিতে দেখে আমাদের তখন তাই মনে হয়েছে। এই মুশতাকই জেলের তালা খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং তাই জাতীয় চার নেতা জেলখানায় খুন হন। মনে রাখা দরকার, কাদের সিদ্দিকীকে আমরা এখন যতই গালি দিই না কেন, একমাত্র সেদিন তিনিই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বাকি সবাই বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে আপস করেছেন। এও জানিয়ে রাখি, খন্দকার মুশতাকের বাড়িতে কিন্তু একটি ঢিলও পড়েনি?

আমি দীর্ঘ কুড়ি বছর যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু পরিষদের সেক্রেটারি ছিলাম। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭-তে ইস্তফা দিয়েছি। মাঝে মাঝে ভাবি, আমি কি করেছি বঙ্গবন্ধুর জন্য? বঙ্গবন্ধু আমাদের একটি দেশ এবং একটি পাসপোর্ট দিয়েছেন বলেই আমরা আজ বিদেশে বসে তার পক্ষে-বিপক্ষে লম্বা লম্বা ডায়ালগ দিতে পারছি। মানুষের সামান্য কৃতজ্ঞতাবোধও তো থাকে? আমার সৌভাগ্য, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর ঘটনাচক্রে আমিও কলকাতা যাই। লতিফ সিদ্দিকী, খালেদ খুররম বা ইসমাত কাদির গামা, দীপঙ্কর তালুকদার, নরসিংদীর এমপি মোসলেউদ্দিন বা যশোরের এমপি রওশন আলী, সুনীল গুহ, হরে কৃষ্ণ দেবনাথ বা অন্যদের সান্নিধ্যে আসি। ভাঙুরে শেখ সেলিম তো ছিলেনই। সে যাত্রায় অবশ্য পালিয়েই বাংলাদেশে ফিরতে হয়? সে অন্য কাহিনি। ২০১৮-এর জাতীয় শোক দিবসে জাতির পিতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close