আন্তর্জাতিক ডেস্ক

  ০৫ আগস্ট, ২০১৯

শরণার্থী থেকে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট!

তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ লাটভিয়া। পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না ছোট্ট ফ্রেইবারগার। ৫০ বছর দেশের মাটির স্পর্শ পাননি তিনি। আর যখন নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবেই তাকে বরণ করে নেয় দেশের জনগণ। সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভাইরা-ভাইক ফ্রেইবারগার সে সময়ের জীবনের নানা মুহূর্ত।

ফ্রেইবারগা বলেন, ‘আমার মা-বাবা কখনোই ভুলে যেতে দেননি যে আমি একজন লাটভিয়ান।’

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাল্টিক রাষ্ট্রে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে নাৎসি জার্মানি ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। বাল্টিক রাষ্ট্র বলতে উত্তর ইউরোপে বাল্টিক সাগরের তীরে অবস্থিত রাষ্ট্রগুলোকে বোঝায়। এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া এ তিনটি দেশকে বলা হয় বাল্টিক রাষ্ট্র।

ফ্রেইবারগার মনে আছে, ১৯৪৪ সালের সে উত্তপ্ত সময়ের কথা। শুরু হয় বাঁচা-মরার লড়াই। ওই সময় সাত বছর বয়সি ছোট্ট ফ্রেইবারগাকে নিয়ে তার পরিবার প্রথমে বিধ্বস্ত জার্মানির উদ্দেশে রওনা দেয়। এরপর তারা ফরাসি অধ্যুষিত দেশ মরক্কোতে যান। পরে থিতু হন কানাডায়। এভাবেই চলতে থাকে ফ্রেইবারগার জীবন।

এরপর ৫০ বছরেরও বেশি সময় কেটে যায়, লাটভিয়ার দেখা মেলে না ফ্রেইবারগার। শেষমেশ ১৯৯৮ সালে নিজ দেশে ফেরেন তিনি। আর মাত্র আট মাসের মাথায় হয়ে যান মাতৃভূমির প্রেসিডেন্ট।

১৯৪৫ সালে নববর্ষের রাতে পরিবারসহ দেশ ছেড়েছিল ফ্রেইবারগার পরিবার। ওই সময়ের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আমরা পালানোর জন্য একটি জাহাজে উঠেছিলাম। জাহাজটি ছিল সেনাবাহিনী এবং অস্ত্রের পরিবহন জাহাজ। ধরা পড়লে অবশ্যই অনেক বড় ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তবে ওই জাহাজে যথেষ্ট সংখ্যক বেসামরিক মানুষ নেওয়া হয়েছিল, যারা নিজেরাও যেকোনো মূল্যে কমিউনিজম থেকে মুক্তি পেতে চাইত। সেখানে জাহাজের ডেকে বিভিন্ন সময় লাটভিয়ানরা জড়ো হতেন আর লাটভিয়ান গান গাইতেন।’

একসময় জার্মানিতে শরণার্থী শিবিরে পৌঁছায় ফ্রেইবারগার পরিবার। সেখানকার পরিস্থিতি ছিল খুব করুণ। এর মধ্যেই ফ্রেইবারগার ১০ মাস বয়সি ছোট বোন মারা যায় নিউমোনিয়ায়। বছর পেরোতেই ফ্রেইবারগার মা একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দেন।

ওই সময়ের একটি করুণ স্মৃতি মনে করে ফ্রেইবারগা বলেন, ১৮ বছর বয়সি একজন তরুণী আমার মায়ের সঙ্গে এক কক্ষেই ছিলেন। সেখানে একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দেন ওই তরুণী। কিন্তু সে সন্তানকে কিছুতেই গ্রহণ করতে চাইছিলেন না তিনি। নিজের সন্তানকে কোনো নামও দিতে চাননি তরুণীটি। কারণ, রাশিয়ার সেনাদের দলবদ্ধ ধর্ষণের ফলে জন্ম নেয় ওই সন্তান।

ফ্রেইবারগা বলেন, যখনই নার্সরা ওই শিশুকে তার মায়ের কাছে এনে রাখছিলেন, ওই তরুণী দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন আর কাঁদতেন। তিনি তার সন্তানের সঙ্গে কথা বলতে চাইতেন না। নার্সরা ওই শিশুটির একটি নাম দিয়েছিলেন ‘মারা’। যেটি ছিল আমার ছোট বোনের নাম।

‘আমি ভাবতাম অনেক বেশি কিছুই হয়ে যাচ্ছে। একটি ছোট্ট শিশু ‘মারা’, যে জন্ম নিয়েছে, বাঁচতে চাইছে, কিন্তু এই পৃথিবী তাকে চায় না। আর আমার ছোট বোন ‘মারা’, যাকে আমরা সবাই চাইতাম, কিন্তু পাইনি। বুঝতে পারলাম, জীবন অনেক অদ্ভুত,’ যোগ করেন ফ্রেইবারগা।

১১ বছর বয়সে ফ্রেইবারগা মরক্কোর ক্যাসাব্লাঙ্কায় চলে যান। এর কিছুদিনের মধ্যেই পরিবারসহ কানাডায় যান তিনি। সেখানে ১৬ বছর বয়সে একটি ব্যাংকে চাকরি পান ফ্রেইবারগা। সে সঙ্গে রাত্রিকালীন স্কুলে যেতেন তিনি। পরে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। সেখানে তিনি পরিচিত হন আরেক লাটভিয়ান ইম্যান্টস ফ্রেইবার্গসের সঙ্গে, যাকে পরে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেন ফ্রেইবারগা।

টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়তেন ফ্রেইবারগা। পরে ১৯৬৫ সালে পিএচডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।

ফ্রেইবারগা কানাডার মন্ট্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৩ বছর অধ্যাপনা করেছেন। তিনি মোট পাঁচটি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। সে সঙ্গে লিখেছেন ১০টি বই।

১৯৯৮ সালে ৬০ বছর বয়সে ইমেরিটাস প্রফেসর নির্বাচিত হন ফ্রেইবারগা এবং পরে অবসর নেওয়ার চিন্তা করেন। কিন্তু এরই মধ্যে হঠাৎ এক দিন বেজে ওঠে ফ্রেইবারগার ফোন। ওপাশ থেকে লাটভিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাকে লাটভিয়ার নতুন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান করার কথা জানান।

ফ্রেইবারগাকে জানানো হয়, তারা এমন একজনকে চান, যার বিভিন্ন ভাষায় দখল আছে এবং যিনি পশ্চিমা মনোভাব বোঝেন। এছাড়া যার লাটভিয়ার সংস্কৃতি সম্পর্কেও বেশ ভালো বোঝাপড়া আছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close