আন্তর্জাতিক ডেস্ক

  ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

যেভাবে ‘কাশ্মীর হামলার হোতা’

জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ভয়াবহ জঙ্গি হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে যাকে সন্দেহ করা হচ্ছে, সেই আদিল আহমেদ পাকিস্তানের নয়, ভারতীয় কাশ্মীরের পুলওয়ামারই সন্তান। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফের খবর থেকে জানা গেছে, ইসলামের সুফিবাদী ধারা হিসেবে পরিচিত ‘বেরেলভি’ মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। আদিলের বন্ধু-স্বজন-আত্মীয়রা টেলিগ্রাফকে জানিয়েছেন, বুরহান ওয়ানির হত্যাকা- আর নিরাপত্তা বাহিনীর গুলির আঘাতে বহু মানুষের অন্ধ হওয়ার ঘটনাই তাকে ভিন্নপথে তাড়িত করেছিল। এদিকে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আদিলের বাবা গুলাম হোসেন দাবি করেছেন, ২০১৬ সালের বিক্ষোভের সময় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ভয়াবহ নিপীড়নের শিকার হয়েছিল আদিল। তারপর থেকেই সে বদলে যেতে থাকে।

গত বৃহস্পতিবার কাশ্মীরের পুলওয়ামাতে দেশটির ‘সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের’ গাড়ি বহরে আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। আরডিএক্স বিস্ফোরক ভর্তি গাড়ি নিয়ে একজন হামলাকারী বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে বহরের ৭০টি গাড়ির মধ্যে একটি বাস সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত হয়ে যায়। সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, এতে বাহিনীটির ৪৪ জন সদস্য প্রাণ হারিয়েছে। হামলার পর জইশ-ই-মুহাম্মদ নামের জঙ্গি সংগঠন এর দায় স্বীকার করে। তারা দাবি করে, তাদের হয়ে পুলওয়ামারই এক বাসিন্দা আদিল আহমেদ দার ওই হামলা চালিয়েছে।

ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পুলওয়ামায় যেখানে আত্মঘাতী হামলার ঘটনাটি ঘটেছে সেখান থেকে ১০ কিলোমিটার দূরের কাকাপোরায় আদিলের বাড়ি। তার স্কুল ছিল হাঁটা পথে বড়জোর দুই কিলোমিটার দূরে। আদিলের বাবা গুলাম হোসেন দার একজন ফেরিওয়ালা। আদিলের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে দ্য টেলিগ্রাফ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০ বছরের আদিল জইশ-ই-মুহাম্মদে যোগ দেওয়ার আগে বেরেলভি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল।

টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঐতিহ্যগতভাবে কাশ্মিরের সমাজের প্রায় প্রতিটি অংশ থেকেই জঙ্গিরা সমর্থন পেয়ে থাকে। বৃহস্পতিবারের হামলার দায় স্বীকারকারী জইশ-ই-মোহাম্মদ দেওবন্দি ধারায় বিশ্বাসী। দেওবন্দি ধারায় জিহাদে উদ্বুদ্ধ করা হলেও ওই মতাদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থান বেরেসভিসদের। মাজারকেন্দ্রিক সংস্কৃতির চর্চা করে তারা। তাদের ধারায় জিহাদের নামে হত্যাযজ্ঞ নিষিদ্ধ।

একইভাবে সংবাদমাধ্যম এবেলার এক প্রতিবেদনে বেরেলভি ধারা সম্পর্কে বলা হয়েছে, এটি হলো দক্ষিণ এশিয়ায় সুন্নিদের একটি সুফিবাদী আন্দোলন। উত্তরপ্রদেশের বেরেলি জেলার শহর বেরেলিতে এই আন্দোলনের সূচনা। এই আন্দোলন শুরু হয় উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা আহমেদ রাজা খানের হাত ধরে। এই আন্দোলনকারীরা মোটেই জেহাদকে সমর্থন করে না। বরং এরা সন্ত্রাস ও হিংসার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধর্মস্থানে প্রার্থনা করে।

টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলওয়ামাতেও এমন অনেক বাসিন্দা রয়েছে যারা সুফিবাদী। আদিলের পরিবারও সংবাদমাধ্যমের কাছে জানায়, তারাও বেরেলভি আন্দোলনেই বিশ্বাসী। যদিও আদিলেরই এক ভাই মনজুর আহমেদ লস্করে ছিল বলে জানা গেছে। ২০১৬-য় মৃত্যু হয় তার। আদিলের থেকে বয়সে একটু বড় তার আত্মীয় ইমতিয়াজ আহমেদ দার। তিনি মনে করেন, আদিলের তো বেরেলভি মতবাদ বুকে ধারণ করে জিহাদিদের মতাদর্শের সঙ্গে লড়াই করার কথা। ‘আদিল সেই ধর্মবিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিল যা বেরেলভি মতাদর্শের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই গ্রামটা আসলে প্রায় পুরোটাই বেরেলভি মতাদর্শ ধারণ করে। কখনও কখনও আদিল আমাদের গ্রামে নামাজের ইমামতি করত, নবীজীর স্তুতিমূলক নাথ গেয়ে শোনাত সে।’ টেলিগ্রাফকে বলেন ইমতিয়াজ।

উল্লেখ্য, ছাড় এ শরিফ ওই অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাজার, যেখানে সুফিবাদের চর্চা হতো। এই মাজারেই জঙ্গি ও নিরাপত্তা রক্ষীদের মধ্যে বড় রকমের সংঘর্ষ হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। ইমতিয়াজ টেলিগ্রাফকে বলেন, ‘আমরা মসজিদে যেতাম বেরেলভি মতাদর্শের প্রচারকদের কথা শুনতে। প্রতি বছর, রমজান মাসে ছার এ শরিফ মাজারে যেতাম আমরা, রাতভর থাকতাম সেখানে। কয়েক মাস অনন্তনাগের কাছে একটি বেরেলভি ধারার দারুল উলুম মাদ্রাসায় যেতে দেখেছি আদিলকে ওই সুফি ধারা সম্পর্কে আরও ভালো করে জানতে।’

আদিলের এক বন্ধু নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘জিহাদ বেরেলভিসদের পছন্দের বিষয় ছিল না কখনও। ২০১৬ সালে বুরহান ওয়ানিকে হত্যা ও পেলেট বোমায় অনেকে অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আদিল অস্ত্র হাতে নিতে উদ্বুদ্ধ হয়। গ্রামের আরেক বাসিন্দা জানান, আদিল আর তার বন্ধু সামির গত বছর জিহাদি আন্দোলনে যোগ দেয়। ‘স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিচ্ছিলেন সামির। আমরা কখনও তাদেরকে জিহাদি আন্দোলন নিয়ে কথা বলতে দেখিনি। গত বছর তারা যখন জিহাদি আন্দোলনে যোগ দেয়, আমরা পুরো গ্রামের মানুষ বিস্মিত হয়েছিলাম।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৮ জুলাই অনন্তনাগের কোকেরনাগ এলাকায় সেনা ও পুলিশের বিশেষ বাহিনীর যৌথ অভিযানে হিজবুল কমান্ডার বুরহান ওয়ানিসহ তিন হিজবুল যোদ্ধা নিহত হন। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার হয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা বুরহানের হত্যাকান্ডের খবর ছড়িয়ে পড়লে কাশ্মির জুড়ে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। বিক্ষোভ দমনে নিরাপত্তা বাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগে বহু মানুষ নিহত হয়। নিরস্ত্র জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার নামে শুর হয় ছররা গুলির অভিযান। চোখে গুলির ক্ষতের কারণে চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারান অনেকে। সে সময় আউটলুক ইন্ডিয়ায় লেখা নিবন্ধে অরুন্ধতী স্পষ্ট করে মন্তব্য করেন, কাশ্মিরের নিরস্ত্র জনতার প্রতি ভারতীয় বাহিনীর গুলি, হাসপাতাল আর অ্যাম্বুলেন্সে পুলিশের আক্রমণ, ছররা গুলিতে তরুণদের বুক বিদ্ধ করার ঘটনাকে মানবাধিকার পরিস্থিতির বিতর্কে আটকে রাখা যাবে না। একে স্বাধীনতার জন্য একটি জনগোষ্ঠীর সংগ্রামের বিরদ্ধে সামরিক দমননীতি আকারেই দেখতে হবে।

আদিলের বাবা গুলাম হোসেন দার টেলিগ্রাফকে জানান, পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবারের আর্থিক সহায়তা নিশ্চিতে একটি ইস্পাতের কারখানায় কাজ করতো আদিল। দ্বাদশ শ্রেণীতে অকৃতকার্য হয়ে গত বছর মার্চ মাসে সে জিহাদি আন্দোলনে যোগ দেয় সে। ‘আমি একবারই তার হাতে বন্দুক দেখেছিলাম। কেন সে জিহাদিদের সঙ্গে যোগ দিল, আমি ভাবতেও পারি না’। হামলার পর গত শুক্রবার গুলাম হোসেন দার রয়টার্সের কাছে বুরহান ওয়ানি হত্যার পরের বিক্ষোভের স্মৃতিচারণ করেন। তিনি দাবি করেন, সে সময় একদিন আদিল স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল। ‘সেনা সদস্যরা ওকে ধরে অনেকক্ষণ আটকে রাখে। প্রচন্ড মারধর করে। নাকে খত দিয়ে চারপাশে ঘোরায়। এ ঘটনায় ও খুব অপমান বোধ করেছিল। অনেকবার সেই ঘটনার কথা সে আমাদের বলেছে। সেনাবাহিনী কেন তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করল সেই প্রশ্নও ছিল তার।’ তিনি আরও বলেন, তিন বছর আগেকার ওই ঘটনার পর থেকে অনেকটা বদলে যায় আদিল। স্বভাবে রুক্ষ হয়ে ওঠে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close