আন্তর্জাতিক ডেস্ক

  ২৪ অক্টোবর, ২০১৮

কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া সৌদি ‘টাইগার স্কোয়াড’

তুরস্কের ইস্তাম্বুলে জামাল খাশোগিকে হত্যা করেছে সৌদি আরবের ১৫ সদস্যের একটি ডেথ স্কোয়াড। তবে খাশোগি এই স্কোয়াডের প্রথম শিকার নন এবং এটি পরিচালিত হয় প্রভাবশালী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের (এমবিএস) নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে। এই ডেথ স্কোয়াডের নাম টাইগার স্কোয়াড, আরবিতে ফিরকাত এলনেমর। সৌদি আরবের গোয়েন্দা সংস্থা সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের বরাত দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই এসব তথ্য জানিয়েছে। এই টাইগার স্কোয়াড সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই জানে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এক বছর আগে এই স্কোয়াড গঠন করা হয়। সৌদি আরবের বিভিন্ন গোয়েন্দা ও সামরিক সংস্থার দক্ষ ও বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন ৫০ জন সদস্যকে নিয়ে গঠিত হয়েছে স্কোয়াডটি। তাদের প্রত্যেকেই যুবরাজের প্রতি অনুগত। সূত্রটি জানায়, এই টাইগার স্কোয়াডের প্রধান কাজ হচ্ছে গোপনে সৌদি আরবের ভেতরে ও বাইরে ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা করা। এমন হত্যা করা যেন তা সংবাদমাধ্যম, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও রাজনীতিবিদদের মনোযোগ আকর্ষণ না করে। সৌদি নেতৃত্ব বিশ্বাস করে, সমালোচকদের গ্রেফতার করলে তাদের ওপর চাপ বাড়বে। তাই তারা গোপনে ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা শুরু করেছে। টাইগার স্কোয়াড বিভিন্ন উপায়ে হত্যা করে। তবে মাঝে মাঝেই কদর্য আকার ধারণ করে। যেমনটা হয়েছে খাশোগির ক্ষেত্রে। বিভিন্ন গোয়েন্দা ও সামরিক সংস্থার দক্ষ ও বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন ৫০ জনকে নিয়ে স্কোয়াডটি গঠিত।

সূত্রটি জানায়, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হত্যা পরিকল্পনা করা হয়, যাতে নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছাকাছি যেতে না হয়। আর তা যেন দুর্ঘটনা হিসেবে দেখা যায়। যেমনÑ গাড়ি দুর্ঘটনা বা বাড়িতে অগ্নিসংযোগ। টাইগার স্কোয়াড একবার এক ভিন্নমতাবলম্বীকে ভয়ংকর ভাইরাস শরীরে ঢুকিয়ে হত্যা করেছে। হাসপাতালে নিয়মিত চেকআপের সময় এই ভাইরাস প্রবেশ করানো হয়েছিল।

ব্যাপক আন্তর্জাতিক চাপের মুখে শনিবার খাশোগি কনস্যুলেটে নিহত হয়েছেন বলে স্বীকার করে সৌদি আরব এবং সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার উপপ্রধান মেজর জেনারেল আসিরিকে এই হত্যায় দায়ী করে বরখাস্ত করা হয়েছে। সৌদি সূত্রটি জানায়, সহকর্মীদের মধ্যে জেনারেল আসিরি ‘দক্ষিণের বাঘ’ (টাইগার অব দ্য সাউথ) বলে সুপরিচিত। ইয়েমেনে সৌদি জোটের যুদ্ধ শুরু হওয়ায় সৌদি সংবাদমাধ্যমে আসিরিকে ‘জানোয়ার’ আখ্যায়িত করা হয়। আসিরিও এই ডাকনাম পছন্দ করতেন।

টাইগার স্কোয়াড কীভাবে নির্দেশনা পায়, তা জানা নেই বলে জানিয়েছে সূত্রটি। তবে জানিয়েছে, আসিরি ও যুবরাজের ঘনিষ্ঠ সৌদ আল কাহতানি স্কোয়াডটির কমান্ড কাঠামোতে রয়েছেন। কাহতানিকেও শনিবার বরখাস্ত করা হয়েছে। যুবরাজ তার একেবারে অনুগত ও বিশ্বস্ত পাঁচ দেহরক্ষীকে এই টাইগার স্কোয়াডে রেখেছেন। তাদের মধ্যে তিনজন খাশোগি হত্যায় ইস্তাম্বুলে কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া ১৫ জনের মধ্যে ছিলেন। তারা হলেনÑ মাহের আব্দুল আজিজ মুতরিব, মোহাম্মদ আল জাহরানি ও ডার আল হারিবি।

মুতরিব একজন কূটনীতিক ও মেজর জেনারেল। তিনি এ বছরের শুরুতে যুবরাজের বোস্টন, হউস্টন ও নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সফরে সঙ্গে ছিলেন। মুতরিবকে টাইগার স্কোয়াডের মেরুদন্ড বলে আখ্যায়িত করেছে সূত্রটি। জানায়, তাকে এমবিএস নিজেই করেছেন। মুতরিবের ওপর নির্ভরশীল ও ঘনিষ্ঠ যুবরাজ। নিজের কাছের দেহরক্ষীদের এই স্কোয়াডে নির্বাচন করেছেন যুবরাজ; যাতে করে তারা সরাসরি যোগাযোগের মধ্যে থাকে এবং হত্যাকান্ড তদারকি করতে পারেন।

সূত্রটি জানায়, ২ অক্টোবর মুতরিবের অন্তত ১৪টি ফোনকল আড়ি পেতে শুনেছে তুরস্ক। এই ১৪টির মধ্যে অন্তত সাতটি ফোনকল করা হয়েছে যুবরাজের কার্যালয়ে। তবে এই ফোনকল খাশোগি হত্যাসংশ্লিষ্ট কি না, তা স্পষ্ট করেনি সূত্রটি। তবে জানিয়েছে, যদি তুর্কি কর্তৃপক্ষ এসব ফোনকলের কথোপকথন ফাঁস করে, তাহলে তা হবে একেবারে ‘বিস্ফোরক’ তথ্য। এই সূত্রের মতে, খাশোগির শরীরে ভয়ংকর মাদক ইনজেকশন পুশ করেন মুতরিব। এরপর কনস্যুলেটের একটি টেবিলে তার শরীর টুকরো টুকরো করা হয়।

মিডল ইস্ট আই জানায়, সূত্রটি যা জানিয়েছে তাতে ধারণা করা হচ্ছে মরফিন দেওয়া হয় খাশোগিকে। তুর্কি তদন্তকারীরাও জানিয়েছেন, একটি টেবিলে খাশোগিকে টুকরো করা হয়। খাশোগি হত্যায় অংশ নেওয়া যুবরাজের দেহরক্ষীদের কয়েকজন।

এদিকে, তুর্কি সংবাদপত্র ইয়েনি সাফাক সোমবার জানিয়েছে, খাশোগিকে হত্যার আগে যুবরাজের সঙ্গে কথা বলেছেন মুতরিব। অন্যান্য তুর্কি সংবাদমাধ্যমও খাশোগি তদন্তের বিভিন্ন তথ্য ফাঁস করে চলেছে। ইয়েনি সাফাক জানায়, খাশোগিকে যখন হত্যা করা হয়, তখন যুবরাজের ব্যক্তিগত কার্যালয়ের প্রধানের সঙ্গে অন্তত চারবার ফোনে কথা বলেছেন মুতরিব।

টাইগার স্কোয়াডের প্রথম দিকের গোপন কিলিং অপারেশনগুলোর একটি পরিচালনা করা হয় সৌদি সীমান্তের কাছে। গত বছর নভেম্বরে সাবেক যুবরাজ ও আসির প্রদেশের ডেপুটি গভর্নর প্রিন্স মনসুর বিন মকরিনকে হত্যা করে স্কোয়াডটি। প্রিন্স মনসুর সৌদি যুবরাজের বিরোধিতাকারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সৌদি আরবের ইয়েমেন সীমান্তে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন তিনি। প্রিন্স মনসুর দেশ ছেড়ে পালাতে চেয়েছিলেন। ৪ নভেম্বর সৌদিতে রাজপরিবারে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নিহত হন তিনি।

সূত্রটি জানায়, খাশোগি হত্যায় ১৫ সদস্যের একজন ও টাইগার স্কোয়াডের সদস্য মেশাল সাদ আল-বোস্তানি জড়িত প্রিন্স মনসুরের হত্যাকান্ডে। সূত্রমতে, সৌদি আরবের রয়্যাল এয়ার ফোর্সের লেফটেন্যান্ট বোস্তানি। আরেকটি হেলিকপ্টার থেকে মিসাইল নিক্ষেপ করে প্রিন্স মনসুরের হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত করেন তিনি। হত্যা করা হয়েছে একেবারে স্বাভাবিক দুর্ঘটনার মতো করেই।

৩১ বছরের বোস্তানি ১৮ অক্টোবর রিয়াদে কার দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন খবর বেরিয়েছে। তবে সূত্রটি এ বিষয়ে জানায়, এটা মিথ্যা। তাকে একটি কারাগারে বন্দি করা হয়েছিল এবং তার খাবারে বিষ দেওয়া হয়। প্রিন্স মনসুর ও খাশোগি হত্যার গোপন বিষয় জানতেন বোস্তানি।

টাইগার স্কোয়াডের আরেকটি গোপন হত্যাকান্ড পরিচালিত হয় সৌদি আরবের ভেতরেই। তারা মক্কার সরকারি আদালতের প্রেসিডেন্ট, বিচারক শেখ সুলাইমান আব্দুল রহমান আল থুনিয়ানকে ১ অক্টোবর রিয়াদের একটি হাসপাতালে হত্যা করে। সূত্রটি জানায়, আমি মনে করি, তাকে প্রাণঘাতী ভাইরাস শরীরে ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়েছে নিয়মিত মেডিকেল চেকআপের সময়। স্কোয়াডটি জানত, হাসপাতালে যাবেন শেখ এবং তার মৃত্যু স্বাভাবিক হিসেবে ঘটানো হয়েছে। যুবরাজের ভিশন ২০৩০-এর বিরোধিতা করে একটি চিঠি দিয়েছিলেন এই বিচারক। টাইগার স্কোয়াড ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যায় এইচআইভি বা অন্যান্য প্রাণঘাতী ভাইরাস ব্যবহার করে। মিডল ইস্ট আই আল থুনিয়ানের অসুস্থতার কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি।

সৌদি সূত্রটি জানায়, তার জানামতে বিদেশের মাটিতে খাশোগিকে হত্যাই টাইগার স্কোয়াডের প্রথম অভিযান। তবে বিদেশে স্কোয়াডটি এর আগেও বেশ কয়েকটি হত্যার উদ্যোগ নিয়েছিল। সূত্রের ভাষ্য, একটি অভিযানের কথা জানি আমি। কানাডায় সৌদি ভিন্নমতাবলম্বী ওমর আব্দুল আজিজকে কনস্যুলেটে হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি সেখানে অস্বীকৃতি জানান এবং অভিযানটি ব্যর্থ হয়।

এর আগে বিভিন্ন খবরে জানা গেছে, কীভাবে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সফটওয়্যার দিয়ে আব্দুল আজিজকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে সৌদি আরব। সূত্রটি জানায়, কিলিং মিশন যে সফল হয়েছে, তা প্রমাণ করতে টাইগার স্কোয়াডের সদস্যরা খাশোগির একটি আঙুল সৌদি আরবে নিয়ে আসে। আঙুলটি সৌদি আরবের যুবরাজের কাছে উপস্থাপন করা হয়। এমবিএস সর্বদাই বলে থাকেন, যেসব লেখক তার সমালোচনা করবেন তাদের আঙুল তিনি কেটে ফেলবেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close