আন্তর্জাতিক ডেস্ক

  ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

মালদ্বীপের নির্বাচনে ভারতের জয়!

মালদ্বীপের রোববারের নির্বাচনে পরাজয় মেনে নিয়েছেন দেশটির চীনপন্থি প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ ইয়ামিন। সোমবার তিনি এ ঘোষণা দেন। এই নির্বাচনে ভারতের অন্যতম মিত্র ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহর কাছে পরাজিত হন ইয়ামিন। তাই বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মালদ্বীপের নির্বাচনে ভারত ও চীনের মধ্যকার ছায়াযুদ্ধে এই যাত্রায় জিতেছে ভারত আর হেরেছে চীন। হংকংভিত্তিক সংবাদমাধ্যম এশিয়া টাইমস এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে এমন দাবি করেছে।

ইব্রাহিম সোলিহ নির্বাচনে ৫৮ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। কিন্তু কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভুলে গিয়ে ভারত নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণার আগেই তাকে অভিনন্দন বার্তা পাঠায়। প্রাথমিক ফলাফল ঘোষণার পরই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা তৃতীয় প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের সফল সমাপ্তিকে স্বাগত জানাই। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ায় ইব্রাহিম মোহাম্মেদ সোলিহকে আন্তরিক অভিনন্দন।’

এ ফলাফলের বিষয়ে সোমবার পর্যন্ত চীন কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। ছোট দ্বীপরাষ্ট্রটির মাধ্যমে ভারত মহাসাগরের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অংশে প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে ভারতের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে চীন। ২০১৩ সালে ইয়ামিন ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই মালদ্বীপের সঙ্গে চীনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তবে তার সময়ে এসে ঐতিহ্যগত মিত্র ভারতের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়ে। এটা সেখানে চীনের আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ আরো বাড়িয়ে দেয়।

২০১৪ সাল চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং মালদ্বীপ সফর করে সেখানে চীনা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর গড়ে তোলার চুক্তি করেন। রাজধানী মালের কাছের একটি দ্বীপে বিমানবন্দরটির সঙ্গে সড়ক যোগাযোগের জন্য চীনের অর্থায়নে একটি সেতুও নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া চীনের প্রস্তাবিত ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ পরিকল্পনা নিয়েও দেশ দুটি একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। ইয়ামিনের আমলে চীন মালদ্বীপে বিপুল অর্থ বিনিয়োগও করেছে। এই বছরের শুরুতে মালদ্বীপের মাকুনুধুতে একটি জয়েন্ট ওশান অবজারভেশন স্টেশন নির্মাণেরও ঘোষণা দেয় দুই দেশ।

ভারত ও মালদ্বীপের বিরোধী দলগুলো আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছে, চীন সামরিক উদ্দেশ্যে ওই স্টেশনকে ব্যবহার করতে পারে। এজন্য ভারত বিষয়টিতে আপত্তি জানিয়ে আসছিল। আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও মালদ্বীপ ভারত মহাসাগরে গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে। দেশটির উত্তর-দক্ষিণে ৭৫০ কিলোমিটার বিস্তৃত জলসীমা রয়েছে। ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে ভারত আঞ্চলিক প্রভাব ধরে রাখার জন্য মালদ্বীপকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। দেশটির অতীতের অস্থিতিশীলতায় ভারতের হস্তক্ষেপেই বিষয়টি বোঝা যায়। ১৯৯৮ সালে শ্রীলঙ্কার তামিল বিদ্রোহীরা মালদ্বীপ সরকারকে উৎখাত করতে চাইলে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধী সেখানে ১৬০০ ভারতীয় সেনা পাঠান।

তারা মালদ্বীপ সরকারকে সহায়তা করে তামিলদের সেখান থেকে সরিয়ে দেয়।

মালদ্বীপ ১৯৭৮ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট মামুন আব্দুল গাইয়ুমের স্বৈরশাসনের অধীনে ছিল। ওই সময় দেশটি তার পর্যটন খাতের উন্নয়ন ঘটায়। ওই সময় দেশজুড়ে উন্নয়ন হলেও গাইয়ুমের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। ২০০৮ সালে দেশটিতে প্রথমবারের মতো সত্যিকারের গণতান্ত্রিক নির্বাচন হলে বিস্ময়করভাবে মোহাম্মদ নাশিদের কাছে ক্ষমতা হারান প্রেসিডেন্ট গাইয়ুম। তারপর নাশিদ দেশটিতে গণতান্ত্রিক ধারা চালু ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেন। কিন্তু ২০১২ সালের বিতর্কিত পরিস্থিতিতে নাশিদ ক্ষমতাচ্যু হন এবং ২০১৫ সালে ইয়ামিন ক্ষমতায় এলে তাকে জেলে যেতে হয়। নাশিদকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দুর্নীতির মামলায় জেল দেওয়া হয় বলে তখন দাবি করে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। যুক্তরাষ্ট্রও ওই ঘটনার প্রতিবাদ জানায়। ২০১৬ সালে রাজনৈতিক আশ্রয় পেলে তাকে যুক্তরাজ্য যেতে দেয় ইয়ামিন সরকার।

এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশটিতে অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা দেখা দিলে নাশিদ ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রকে সেখানে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানান। এমনকি নাশিদ সেনাবাহিনীসহ একজন কর্মকর্তাকে মালদ্বীপে পাঠানোর জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ করেন।

নাশিদ ভারত ও পশ্চিমা বিশ্বের সহানুভূতি পাওয়ার জন্য চীনের বিরুদ্ধে দ্বীপটির ভূমি দখলের অভিযোগ তোলেন। এমনকি এসব ভূমি সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হবে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। তবে মালেতে চীনা দূতাবাস এসব অভিযোগ অস্বীকার করে। দূতাবাস জানায়, এই ধরনের মন্তব্য এই অঞ্চলের নিরাপত্তাকে বিপন্ন করবে ও চীনা জনগণের অনুভূতিতে আঘাত করবে। এরপর চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্র গেন্ডাবাল টাইমসের এক খবরে বলা হয়, মালদ্বীপে ভারতীয় সামরিক পদক্ষেপ থামাবে চীন। তবে তাতে বিস্তারিত কোনো কিছু বলা হয়নি। ফেব্রুয়ারি সংকটের সময় ভারত কোনো সামরিক পদক্ষেপ নেয়নি। বরং তারা নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অপেক্ষা করছিল।

নাশিদ জীবনের বেশির ভাগ সময় শ্রীলঙ্কায় নির্বাসনে ছিলেন। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর নাশিদ কলম্বোতে সাংবাদিকদের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কা সরকারকে সম্পৃক্ত হয়ে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াকে সহজ করার আহ্বান জানান।

নাশিদ এখনো মালদ্বীপের রাজনৈতিক দল এমডিপি চেয়ারম্যান। তার দলসহ তিনটি দল মিলে বিরোধী জোট থেকে ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহকে মনোনয়ন দেয়। তবে আগামী নভেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন। এই অন্তর্র্বর্তী সময়ে আসলে কী ঘটবে, তা এখনো অনিশ্চিত।

ইয়ামিনের সময়ে ভারতকে কার্যকরভাবে এড়িয়ে চলা হয়েছে। তাই তারা অবশ্যই চাইবে যাতে শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নতুন প্রেসিডেন্টের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়। এর মাধ্যমে তারা দেশটিতে আবারও নিজেদের অবস্থান ফিরে পাবে। আর চীন নিশ্চিতভাবেই সেখানে তাদের পূর্ববর্তী প্রভাব হারাবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close