আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ভারতে রাম রাজনীতিই শেষ ভরসা!
১৪ নভেম্বর দিল্লির সফদরজং স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করবে ‘শ্রী রামায়ণ এক্সপ্রেস’। সেই ট্রেন চালুর আগেই বিতর্ক দানা বেঁধেছে। বিরোধীরা বলছে, রামায়ণ এক্সপ্রেসে চড়ে ভোট বৈতরণী পার হতে চাইছে গেরুয়া শিবির। বছর ফুরোলেই ভারতে সাধারণ নির্বাচন। এবার আগেভাগেই বিতর্ক শুরু হয়েছে ‘রাম’ নিয়ে। বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে এবার একটি বিশেষ ট্রেন। সেটির নাম ‘?শ্রী রামায়ণ এক্সপ্রেস’। ইতিহাস নয়, পুরাণে বর্ণিত রাম জন্মভূমি থেকে রাম-সীতার বনবাস, ভরতের তপস্যাস্থল, সীতার জন্মস্থান, সদলবলে রামের লঙ্কা যাত্রাÑ এসব ‘পুণ্যস্থল’? ঘুরে দেখা যাবে, সেখানকার মাটিতে পা রেখে ছুঁয়ে দেখার বন্দোবস্ত করেছে ভারতীয় রেলের অধীনস্থ সংস্থা আইআরসিটিসি।
উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের রামেশ্বরমের দিকে যাবে এই ধার্মিক এক্সপ্রেস। মনে করা হচ্ছে, ট্রেন যত ছুটবে, ততই বাড়বে শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির ভোট।
যদিও কেন্দ্রীয় সরকার বা শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির বক্তব্য, সবকিছুতে রাজনৈতিক রং মেশানো বিরোধীদের পুরনো অভ্যাস। রাম না হয়ে রহিম যদি হতো বা অন্য কোনো ধর্মের নামে এই ট্রেন চালু করা হলে কেউ কিচ্ছুটি বলতেন না। আসলে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করেও ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করা এ দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের কৌশল।
দেশজুড়ে লোকাল ট্রেনের বেহালদশা। দূরপাল্লার ট্রেনে যাত্রী সুরক্ষা, নিরাপত্তা বলতে গেলে নেই। তার ওপর ফি বছর বেড়ে চলেছে দুর্ঘটনা। এমন পরিস্থিতিতে ধর্মীয় ট্রেনের ভাবনা সবার স্বার্থে নয়। রেলমন্ত্রীর নিজস্ব অনুসন্ধান রিপোর্ট অনুযায়ী, এ মুহূর্তে দেশের প্রায় ৭০ ভাগ রেললাইন বিপজ্জনক। কারণ যুগ যুগ ধরে সেগুলোর উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার নেই। তার ওপর আধুনিক সিগন্যালিং ব্যবস্থার অভাবে ভারতীয় রেলের সময়সারণী খোদ রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েলের লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতেই আসছে নতুন ট্রেন ‘শ্রী রামায়ণ এক্সপ্রেস’।
রেলভবন সূত্রে জানানো হয়েছে, এই ধর্মীয় সফর শুরু হবে দিল্লির সফদরজঙ্গ থেকে। প্রথম স্টপেজ, উত্তর প্রদেশে রামের জন্মস্থান অযোধ্যায়। এরপর একে একে হনুমানগড়ি, রামকোট, কনক ভবন মন্দির ছুঁয়ে ট্রেন চলে যাবে ভরতের তপস্যাস্থল নন্দীগ্রামে। বর্তমান ফৈজাবাদের কাছে অবস্থিত নন্দীগ্রামেই বনবাস থেকে রামের ফেরা পর্যন্ত তপস্যা করেছিলেন ভরত। নভেম্বরে চলতে শুরু করবে ট্রেন। তার আগেই দেশের রাজনীতি ট্রেনে চেপে বসেছে। রাজনৈতিক তরজা চলছে সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলোতে। কাটাছেঁড়া যা-ই হোক একটা বিষয়ে সবপক্ষ একমত।
বিরোধীরা মনে করে, এই ট্রেন চালুর পেছনে রয়েছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ভাবাবেগকে স্পর্শ করার অভিপ্সা। কিন্তু ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের হঠাৎ রামায়ণ মনে পড়ল কেন? এটা কি তবে ঘুরপথে ধর্মীয় প্রচার? অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, শুধু হিন্দু ধর্ম কেন, অন্য ধর্মের সঙ্গে জড়িত স্থানগুলো ঘুরিয়ে দেখানোর ব্যবস্থাও হোক। কেউ বলছেন, রাম দেখালে রহিম দেখাবেন না কেন?? কোনো একটি বিশেষ ধর্মের জন্য বিপুল টাকা ব্যয়ে ট্রেন চালানোর সরকারি এ উদ্যোগের সমালোচনা হচ্ছে। অনেকের ধারণা, এতে ভক্তির থেকে ভোটের তাগিদই বেশি।
পুরাণ মতে, রামচন্দ্রের নামের সঙ্গে জড়িত তীর্থভূমি অযোধ্যা, সীতামারি, বারাণসী, নাসিক, রামেশ্বরে একযোগে ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হবে। যেসব তীর্থস্থানে ট্রেন থামবে, সব জায়গাতেই আইআরসিটিসির পক্ষে তীর্থযাত্রীদের জন্য রাতে থাকার ব্যবস্থা করা হবে। যাত্রীদের সহায়তার জন্য থাকবেন আইআরসিটিসি’র ট্যুর ম্যানেজার। প্রতিটি স্টেশনে ট্রেন থামার পর সেখান থেকে তীর্থযাত্রীদের পৌরাণিক স্থানে পৌঁছাতে সাহায্য করবেন রেলকর্মীরা। পৌরাণিক গল্প অনুযায়ী, রাম লঙ্কায় গিয়ে রাবণ বধ করেছিলেন। সীতাকে উদ্ধার করে ফিরিয়ে এনেছিলেন। তাই দক্ষিণ ভারতের রামেশ্বরমে ‘শ্রী রামায়ণ এক্সপ্রেস’ পৌঁছানোর পর যাত্রীদের ইচ্ছা হলে ঘুরে আসতে পারেন শ্রীলঙ্কা। সেদেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেন্নাই বিমানবন্দরে বিমানের ব্যবস্থাও করবে আইআরসিটিসি। ট্র্রেনে চড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাতায়াত করেন রাজ্যসভার নির্দল সংসদ সদস্য ঋতব্রত ব্যানার্জি।
রেল পরিষেবায় ঘাটতির অভিযোগে একাধিকবার সংসদে সরব হতে দেখা গেছে তাকে। মোদি সরকারের ধর্মীয় স্থান পরিদর্শন করানোর এই উদ্যোগ সম্পর্কে তিনি ক্ষোভ উগরে দিলেন। ডয়চে ভেলেকে ঋতব্রত বললেন, ?এই ট্রেনে আমজনতার কোনো লাভ নেই। যেখানে ট্রেনের যাত্রী সুরক্ষা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে, সেখানে বুলেট ট্রেনের পর এমন ধর্মীয় ভাবাবেগ উসকে দেওয়ার ট্রেন চালু করা হাস্যকর ঘটনা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইতিহাসকে নির্ভর করে পর্যটনের ব্যবস্থা থাকে। একমাত্র ভারতেই পৌরাণিক চরিত্রকে আঁকড়ে ধরে রেল সার্কিট তৈরি করা হচ্ছে।
এর পেছনে কারণ একটাই, যেহেতু রাম মন্দির তৈরি করে ধর্মীয় মেরুকরণ করা যাচ্ছে না, তাই নির্বাচনের মুখে রামের তাসখেলা শুরু করা হচ্ছে।
এর পেছনে সত্যিই কি রাজনীতি লুকিয়ে আছে? সরকারের দায়বদ্ধতা নেই? তার কথায়, ?সামনেই লোকসভা নির্বাচন। এই সরকারের ওপর সাধারণ নাগরিকের ক্ষোভ কারো অজানা নেই। তাই অনেক ভেবেচিন্তে বিজেপি?র কর্তারা আরএসএসের যুক্তিতে রেলমন্ত্রীকে ব্যবহার করে তাদের আদি ও একমাত্র তুরুপের তাস বের করেছে। সেটা হলো এই ‘?শ্রী রামায়ণ এক্সপ্রেস’। ?জনগণের ট্যাক্সের টাকায় একটা নির্বাচিত সরকার তাদের রাজনৈতিক অভিসন্ধি পূরণ করছে। এর থেকে দুর্ভাগ্যজনক আর কিই?বা হতে পারে। অন্য কোনো দেশে এমনটা ভাবা যায় না।
বিরোধীদের এসব বক্তব্যের জবাব বিজেপিও দিয়ে চলেছে। বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক রাহুল সিনহা ডয়চে ভেলেকে বললেন, ভারতে উন্নয়নে বাধা দেওয়াই বিরোধীদের কাজ। দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নিন্দায় সরব হওয়া গবেষণার বিষয় হতে পারে। দক্ষিণ-?পূর্ব এশিয়ায় রামচন্দ্র মর্যাদা পুরুষোত্তম। ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলিম প্রধান দেশে রামের নামে বহু স্থাপত্য আছে। এমনকি বিমানবন্দরের নামটিও গড়ুর। তারা রামকে ধর্মের মাপকাঠিতে বেঁধে রাখেননি। অথচ এ দেশে কিছু মানুষ নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করলেও রামের নাম শুনলেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠছে। তাহলে বড় প্রশ্ন, এরা কি প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ?? নাকি ধর্মের নামে ভোটবাক্সের দিকে নজর রাখছে?
রাহুল আরো বলেছেন, এ নিয়ে কোনো রাজনীতি নেই। এটা সংস্কৃতির বিষয়। গেরুয়া রং নিয়ে বিরোধীদের বড্ড আপত্তি। দেশের জাতীয় পতাকার সবার ওপরের রংটিই তো গেরুয়া। এই রং ত্যাগের প্রতীক। তাহলে কথায় কথায় গেরুয়াকরণ কেন বলা হচ্ছে??
"