আন্তর্জাতিক ডেস্ক
লেবাননে প্রথম সাধারণ নির্বাচন ৯ বছরের মধ্যে
নয় বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন লেবাননের ভোটাররা। গতকাল রোববারের এই সাধারণ নির্বাচন দেশটির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। এ দিন ভোরে রাজধানী বৈরুতের রাস্তাগুলো ফাঁকা থাকলেও ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা স্কুলগুলোর আশপাশে ভিড় ছিল বলে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। স্কুলের দেয়ালগুলোয় দলীয় পতাকা ও এগিয়ে থাকা প্রার্থীদের ছবি আঁকা হয়েছে। সরকারি চাকরিতে থাকা আবু সামি নামের ৪০ বছর বয়সী এক ভোটার বলেছেন, ‘প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিকদের নিয়ে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, আজ আমি নতুন কোনো মুখকে বেছে নেব।’ প্রতিবেশী সিরিয়ায় সাত বছর ধরে চলা যুদ্ধের কারণে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যে উত্তেজনা চলছে, তার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে লেবানন। সিরিয়া থেকে আসা শরণার্থীদের কারণেও চাপে আছে দেশটি। এসবের পাশাপাশি গত নির্বাচনের পর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে চলা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়েও যাচ্ছে দেশটি।
টেলিভিশনের ফুটেজে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী ছোট এ দেশটির ভোটারদের ভোটকেন্দ্রের সামনে দীর্ঘ সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। নতুন নিয়মে হওয়া এবারের ভোটেও বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগির বিধান বলবৎ থাকছে। রোববার স্থানীয় সময় সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিক গণনার তথ্য প্রকাশ হবে কয়েক দিনের মধ্যে।
দেশটির নির্বাচনী আইনে দলগুলোর সম্ভাবনা নিয়ে জরিপ প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আছে। তবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ফল যাই হোক না কেন, ২০১৬-এর পর থেকে যে উপায়ে লেবাননের সরকার পরিচালিত হয়েছে, এবারও সেই একই পদ্ধতিতে শক্তিশালী দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি হতে যাচ্ছে।
নির্বাচনে সাদ আল হারিরি নেতৃত্বাধীন সুন্নি মুসলমানদের দল ফিউচার মুভমেন্ট পার্টি এবং ইরান সমর্থিত শিয়া দল হিজবুল্লাহ ও এর মিত্ররা কেমন ফল করে তা জানতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন বিশ্লেষকরাও।
সাধারণভাবে দেশটিতে কখনো সৌদি আরব, কখনো ইরানের প্রভাব বেশি দেখা গেছে। এবারের নির্বাচনের আগে রিয়াদ তার পুরনো মিত্র হারিরির পূর্ণ সমর্থন আদায় করে নিয়েছে। ২০০৯ সালেও তারা ফিউচার মুভমেন্টকে সমর্থন দিয়েছিল।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নির্বাচনের পর দ্রুত সরকার গঠন সম্ভব হলে তা বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে লেবাননের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। রাজস্ব ও অন্যান্য খাতে সংস্কারের শর্তে গত মাসেই দাতারা দেশটিকে নমনীয় সুদে ১১ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
কয়েক বছরের রাজনৈতিক টানাপড়েনের পর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা লেবাননের স্থিতিশীলতায় গুরুত্বারোপ করেছে বিভিন্ন সূচক নির্ধারণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাও। ২০০৯ সালে হওয়া সর্বশেষ নির্বাচনের পর সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ, সেখান থেকে আসা লাখ লাখ শরণার্থী এবং ধারাবাহিক জঙ্গি হামলা লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গতিপ্রকৃতিতে বড় ধরনের নিয়ামক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
প্রভাবশালী দলগুলোর মতপার্থক্যের কারণে ২০১৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত সংসদ নির্বাচন পিছিয়েছে তিন দফা, দেশটির পার্লামেন্টও নতুন কোনো প্রেসিডেন্ট নিয়োগে একমত হতে পারেনি; আসনভিত্তিক নির্বাচন থেকে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে যাওয়ার বিরোধও এ ক্ষেত্রে অনেকখানিই ভূমিকা রেখেছে।
বেশির ভাগ ভোটারও নিবন্ধিত হয়েছেন তাদের পূর্বপুরুষের এলাকায়, যে কারণে ভোটের আগে আগে অসংখ্য লেবাননিকে বৈরুত থেকে তাদের গ্রামের পথে ফিরতে দেখা গেছে। নির্বাচনের নতুন ও জটিল নিয়মকানুন অনেক ভোটারকে বিভ্রান্ত করায় ফলাফলের ক্ষেত্রে তুলনামূলক নিশ্চিত আসনগুলোর সম্ভাব্য রায় নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এতসব পরিবর্তনও পুরোনো অভিজাতদের দমাতে পারবে না। সাবেক যুদ্ধবাজ ও স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরাই ক্ষমতায় ফিরে আসছে বলে মনে করা হচ্ছে।
দুই বছর আগের মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনে অবশ্য স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জনপ্রিয় দলীয় প্রার্থীদের তুলনায় বেশ ভালো ফল করেছিলেন। সরকারি সেবায় দৈন্যতা, রাস্তাঘাটে আবর্জনার স্তূপ পড়ে থাকার প্রতিক্রিয়ায় সেবারের নির্বাচন সাধারণ জনগণের ক্ষোভের উদগিরণ দেখেছিল বলেও ধারণা রয়টার্সের।
সামান্য সহিংসতা এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক সামান্য উদ্বেগ ছাড়া সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় বড় কোনো ঘটনা না ঘটলেও রোববার ভোটের দিন বৈরুতে নিরাপত্তা বাহিনীর বড় ধরনের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি অন্যান্য বাহিনীর অস্ত্রসজ্জিত গাড়িবহরকে রাজধানীর রাস্তায় ধীরে ধীরে চলতে দেখেছেন রয়টার্সের এক প্রতিবেদক। রাস্তার মোড়ে মোড়ে এবং ভোটকেন্দ্রের কাছেও দেখা যাচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরাও এবারের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছে।
"