শরীফুল রুকন, চট্টগ্রাম

  ১৯ নভেম্বর, ২০১৭

মৃত ব্যক্তিরা জমি হস্তান্তরের দাতা!

নূর মোহাম্মদ মারা যান ১৯৯৫ সালে। ওমর মিয়ার মৃত্যু হয় ১৯৮৬ সালে। আর ১৯৮২ সালে মারা যান ওয়াজ খাতুন। কিন্তু এই তিনজন মিলে জমি বিক্রি করেছেন ২০০২ সালে! ঘটনাটি চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও থানাধীন খোলাপাড়া এলাকার। ‘মৃত মানুষদের জমি বিক্রির’ এই ঘটনার অনুসন্ধান করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

নগরের চান্দগাঁও মৌজার ১৬২৪ নম্বর খতিয়ানের ১৫৩৯৬ নম্বর দাগের পুরো জমির মালিক ওমর মিয়া, ৩৭৯২ নম্বর খতিয়ানের ১৫৩৯৬ নম্বর দাগের তিন গন্ডা তিন কড়া জমির মালিক নূর মোহাম্মদ ও ১৬৮০ নম্বর খতিয়ানের ৪১৫ নম্বর দাগের এক গন্ডা দুই কড়া জমির মালিক হলেন ওয়াজ খাতুন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাইফুদ্দিন খালেদ স্বাক্ষরিত সনদে ওমর মিয়া ১৯৮৬ সালের ১৭ অক্টোবর, নূর মোহাম্মদ ১৯৯৫ সালের ২ জানুয়ারি ও ওয়াজ খাতুন ১৯৮২ সালে মৃত্যুবরণ করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের মৃত্যুর পর উক্ত সম্পত্তি উত্তরাধিকারীরা ভোগদখল করে আসছিলেন।

ওই জমি ২০১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সকালে দখল করতে যায় জসিম উদ্দিনের নেতৃত্বে এখলাস মিয়া, আবদুল মোতালেব ও আবদুস শুক্কুরসহ অনেকে। এ সময় তারা দাবি করে-নূর মোহাম্মদ, ওমর মিয়া ও ওয়াজ খাতুন তাদের পুরো জমি বিক্রি করে দিয়েছেন এখলাস মিয়া, আবদুল মোতালেব ও আবদুস শুক্কুরের নামে। এর ‘প্রমাণ’ হিসেবে ১৫ বছর আগের ২০০২ সালের ২৫ জুলাই সম্পাদন করা ৩৪৬৫ নম্বর দলিল ও ২৭ আগস্ট সম্পাদন করা ৫৫০৫ নম্বর দলিল দেখান তারা।

এ ঘটনার পর ২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট জসিম উদ্দিন, এখলাস মিয়া, আবদুল মোতালেব ও আবদুস শুক্কুরের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন নূর মোহাম্মদের ছেলে মো. মাহবুবুল আলম। আদালতের নির্দেশে তদন্ত শেষে পাঁচলাইশ থানার এসআই আবু তালেব তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। এতে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়। এরপর বাদীর নারাজির প্রেক্ষিতে আদালতের আদেশে দ্বিতীয় দফা তদন্ত করে সিআইডি। তবে এবার অভিযোগের সত্যতা মেলে। গত ২৭ আগস্ট আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।

তদন্ত কর্মকর্তা ও সিআইডির ডবলমুরিং জোনের পরিদর্শক দোলন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘২০০২ সালে জমির দাতা হিসেবে যাদের তথ্য দেওয়া হয়েছিল, তারা অনেক বছর আগেই মারা যান। এ ছাড়া ২০০২ সালে সর্বশেষ সম্পাদন করা দলিলের নম্বর হচ্ছে ৩০২৫। এতে স্পষ্ট যে, ২০০২ সালের ২৫ জুলাই সম্পাদন করা ৩৪৬৫ নম্বর দলিল ও ২৭ আগস্ট সম্পাদন করা ৫৫০৫ নম্বর দলিল ভুয়া। ওই জাল দলিল দুটি ব্যবহার করে জালিয়াতচক্রের সদস্যরা নিজেদের নামে ৯৬৯৬ নম্বর খতিয়ান সম্পাদন করে। তদন্তে এসব তথ্য পাওয়ায় চার আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছি।’

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কমিশনার দেবদাস ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘তদন্ত করতে গিয়ে কোনো কর্মকর্তা গাফিলতি করলে সংশ্লিষ্টরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে তদন্ত করে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

এদিকে মাহবুবুল আলমের করা মামলায় গত ১২ নভেম্বর আসামি জসিম উদ্দিন, এখলাস মিয়া, আবদুল মোতালেব ও আবদুস শুক্কুরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আল-ইমরান খান। তবে শনিবার পর্যন্ত কেউই গ্রেফতার হয়নি। শনিবার বিকেলে প্রধান আসামি জসিম উদ্দিনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তার স্ত্রী ফোন ধরে বলেন, জসিম মোবাইল ব্যবহার করেন না। মৃত ব্যক্তিকে জীবিত দেখিয়ে দলিল করার বিষয়টি জানতে চাইলে এড়িয়ে যান জসিমের স্ত্রী।

এদিকে মামলার বাদী মো. মাহবুবুল আলম নগরের বাদুরতলা এলাকায় ‘আরকান মোটর ওয়ার্কস’ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। তিনি অভিযোগ করেন, গোয়েন্দা পুলিশ দিয়ে অস্ত্র মামলায় ফাঁসানোর জন্য আসামিরা গত ৪ মে তার গ্যারেজের পেছনে দুটি অস্ত্র ফেলে যায়। পরে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে ও তদন্ত করে পুলিশ তাকে আসামি করেনি।

মো. মাহবুবুল আলম বলেন, পৈতৃক ভিটে রক্ষা করতে গিয়ে আমরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। প্রধান আসামি জসিমকে আমরা অপহরণ করেছি অভিযোগ এনে মামলা করা হয়েছে আমাদের বিরুদ্ধে। অথচ জসিম প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখন কোনদিকে বিপদে ফেলে, ফাঁসিয়ে দেয়-এই চিন্তায় আমি স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারছি না। খুব অসহায় অবস্থায় আছি।’

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি রতন কুমার রায় বলেন, ‘একশ্রেণির অসাধু দলিল লেখক, রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মচারী ও ভূমি রেকর্ড সংরক্ষণ অফিসের কর্মীদের সহায়তায় জাল দলিল তৈরি করে মানুষকে সর্বস্বান্ত করছে জালিয়াতচক্র। মৃত ব্যক্তিকে জীবিত দেখিয়ে জাল দলিল সম্পাদন গুরুতর অপরাধ। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist