শরীফুল রুকন, চট্টগ্রাম

  ২০ অক্টোবর, ২০১৭

পিবিআইয়ের প্রশ্নবিদ্ধ তদন্ত!

অলিখিত চেক নিয়ে প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে আদালতে মামলা করেন সিরাজুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। এই মামলার তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জমা দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। প্রতিবেদনে নিরপেক্ষ সাক্ষী হিসেবে রাখা হয়েছে আসামিদের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তি ও নিকটাত্মীয়দের। এ ছাড়া জব্দ করা হয়নি অভিযোগ সংক্রান্ত কাগজপত্র। এতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদন। আদালতের আদেশে মামলাটি পুনরায় তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এদিকে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈন উদ্দিন জানিয়েছেন, এই মামলার প্রতিবেদন নিরপেক্ষভাবেই দেওয়া হয়েছে।

গত ৩ জানুয়ারি চট্টগ্রাম আদালতে মামলাটি করেন সিরাজুল ইসলাম। মামলায় অভিযুক্ত তিনজন হলেন মাসুদ এগ্রো প্রসেসিং ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের এমডি আশরাফ হোসেন মাসুদ, ম্যানেজিং পার্টনার মো. মোরশেদ ও হিসাব কর্মকর্তা মো. জামান। অভিযোগটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন আদালত; পরে তদন্তভার পান সংস্থাটির চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের পরিদর্শক সাইফুদ্দিন আনোয়ার। এ মামলায় ১৫ মার্চ আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়।

প্রতিবেদনে ‘নিরপেক্ষ সাক্ষীদের নাম-ঠিকানা নি¤œরূপ’ শিরোনামের কলামে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তারা সবাই আসামিদের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অথবা নিকটাত্মীয়। মাসুদ এগ্রোর সহকারী ম্যানেজার মো. আবু বক্কর, সহকারী পরিচালক ও আসামি মাসুদের ভাগিনা মো. খোরশেদ আলম, ক্যাশিয়ার মো. ফরিদুল আলম, সহকারী হিসাবরক্ষক আসিফ মাহমুদকে নিরপেক্ষ সাক্ষী করা হয়েছে। আসামি মাসুদের নিজ এলাকার বাসিন্দা ও আত্মীয় এবং মাসুদ এগ্রোর কাছে দেনাদার ব্যবসায়ীকে ৫, ৬ ও ৭নং নিরপেক্ষ সাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

তদন্তকালে আলামত হিসেবে কোনো ধরনের হিসাব বই কিংবা অডিট রিপোর্ট জব্দ করেননি তদন্ত কর্মকর্তা সাইফুদ্দিন আনোয়ার। তবুও তদন্ত প্রতিবেদনের ১৪নং ক্রমিকের ‘অনুসন্ধান’ কলামে তিনি উল্লেখ করেছেন, বাদী সিরাজুলের দেওয়া হিসেবের সঙ্গে কোম্পানির ক্যাশ হিসেবের মিল নেই। মালামাল বিক্রির টাকা যথাযথভাবে কোম্পানির ক্যাশ হিসোবে জমা না দিয়ে প্রচুর টাকা আত্মসাৎ করেছেন সিরাজুল। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর মাসুদ গ্রুপের অফিসে গিয়ে সিরাজুল সিকিউরিটি চেকটি ফেরত চাইলে তার কাছ থেকে ২৫ লাখ ২৯ হাজার ৬৩৫ টাকা পাওনা আছে বলা হয়। এর মধ্যে ২৯ হাজার ৬৩৫ টাকা মাফ করে ২৫ লাখ টাকা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বাদী সিরাজুলের ঠিকানায় লিগ্যাল নোটিস পাঠানো হয়। এই প্রেক্ষিতে আদালতে মামলাটি দায়ের করেন সিরাজুল ইসলাম।

বাদীর আইনজীবী সাধনময় ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘সিকিউরিটি চেক নেওয়ার কথা স্বীকার করে তদন্ত কর্মকর্তা ২৫ লাখ ২৯ হাজার ৬৩৫ টাকা পাওনা আছে বলে উল্লেখ করেন। অথচ ওই পাওনার তালিকা ও লিগ্যাল নোটিসটি আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়নি। এতে প্রমাণ হয়, জোরপূর্বক সিকিউরিটি চেকটি নিয়ে আসামিরা জালিয়াতির মাধ্যমে ২৫ লাখ টাকা কথায় ও অংকে লিখেছে।’

মামলার নথিপত্র দেখে জানা গেছে, অলিখিত ‘সিকিউরিটি চেক’ দিয়ে ১০ হাজার টাকা বেতনে বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে মাসুদ এগ্রোতে যোগ দিয়েছিলেন সিরাজুল ইসলাম ২০১৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। প্রতিষ্ঠানটির আটা ও ময়দার ব্র্যান্ডিং ও সরবরাহ করার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। এ ছাড়া চেক ও নগদ টাকা সংগ্রহ করে ক্যাশ বিভাগে রসিদ মূলে জমা দেওয়ার দায়িত্বও দেওয়া হয়। কাজের সুবিধার্থে তাকে একটি মোটরসাইকেল, সিম ও পরিচয়পত্র দেওয়া হয়।

এসবের নিশ্চয়তা জামানত হিসেবে সিরাজুলের কাছ থেকে নেওয়া হয় একটি অলিখিত চেক। চাকরি শেষে সব হিসাব বুঝিয়ে দেওয়ার পর ওই চেকটি ফেরত দেওয়ার শর্ত ছিল। অন্য প্রতিষ্ঠানে ভালো সুযোগ পেয়ে মাসুদ এগ্রোর কর্মকর্তাদের আপত্তি উপক্ষা করে ২০১৬ সালের ৩১ অক্টোবর ওই চাকরি ছেড়ে দেন সিরাজুল। ওইদিনই মোটরসাইকেল, সিম ও পরিচয়পত্রসহ যাবতীয় হিসাব বুঝিয়ে দিয়ে ওই সিকিউরিটি চেকটি ফেরত চান সিরাজুল।

অভিযোগ উঠেছে, সে সময় ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক চেকটিতে সিরাজুলের স্বাক্ষর নেওয়া হয়। পাশাপাশি মাসুদ এগ্রোর কর্মকর্তারা হুমকি দেয়, চাকরি ছাড়লে ওই চেকে ইচ্ছেমতো টাকার অংক লিখে সিরাজুলের ক্ষতি করবে। যদিও সিরাজুলের দাবি, ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসের বেতন ১০ হাজার, খাবার-যাতায়াত বিল ৮ হাজার ৬০০ ও ৬ মাসের কমিশন বাবদ ১৬ হাজার ৮৮৯ টাকা পাওনা রয়েছে তার।

পরবর্তীতে মাসুদ এগ্রোর সাবেক বিক্রয় প্রতিনিধি মো. সালাউদ্দিনসহ আরো কয়েকজন ব্যক্তি সিরাজুলকে জানান, আপস-মীমাংসায় ওই চেকটি ফেরত পাওয়া যাবে। এ প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর মাসুদ এগ্রোর অফিসে চারজনের যৌথ স্বাক্ষরে হিসাব নিষ্পত্তি হয়। এতে সাক্ষর করেন মাসুদ এগ্রোর ম্যানেজিং পার্টনার মো. মোরশেদ, সাবেক সহকারী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম, খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী মো. ফখরুদ্দীন ও ভুক্তভোগী সিরাজুল ইসলাম। ওইদিন সিকিউরিটি চেকটি দাবি করলে উল্টো গালিগালাজ করে সিরাজুলকে বের করে দেওয়া হয়।

মামলার বাদী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘মামলার সাক্ষী ও আমার কাছ থেকে জবানবন্দি নেওয়ার সময় তদন্ত কর্মকর্তা বলেছিলেন-অভিযোগ প্রমাণের জন্য আর কোনো সাক্ষীর জবানবন্দি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু পরে দেখা গেল, প্রতিবেদনে অসত্য তথ্য উল্লেখ করেছেন তিনি।’

বাদী পক্ষের আইনজীবী সাধনময় ভট্টাচার্য্য বলেন, ২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর এক বৈঠকের মাধ্যমে সব হিসাব বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এতে মাসুদ এগ্রোর দুইজনসহ মোট চারজন স্বাক্ষর করেন। অন্যদিকে জোরপূর্বক নেওয়া চেকে তারিখ দেওয়া হয় ০১-১১-২০১৬; পরের দিন ওই চেকটি ব্যাংকে ডিজঅনার হয়। আসামিদের কথিত হিসাব চূড়ান্ত করার আগেই চেক ডিজঅনার হওয়া ও চেকে তারিখ বসানো প্রমাণ করে তাদের দাবি মিথ্যা। পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনের বিপক্ষে গত ১৮ অক্টোবর আদালতে নারাজি দিলে মামলাটি গোয়েন্দা পুলিশকে পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেন চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম এস এম মাসুদ পারভেজ।

জানতে চাইলে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈন উদ্দিন বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন কারো পক্ষে না গেলে তিনি স্বাভাবিকভাবেই নানা যুক্তি তুলে ধরবেন। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সব পক্ষকে খুশি করে তো প্রতিবেদন দেওয়া যায় না। পক্ষে না গেলেই ঝামেলা।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist