পাঠান সোহাগ
মেডিক্যাল বর্জ্য ট্রিটমেন্ট নেই, হুমকিতে জনস্বাস্থ্য
গুটিকয়েক বাদে রাজধানীর সব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান চলছে পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই। আর গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ছাড়পত্র থাকলেও সেখানে মাত্র পাঁচটি বাদে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট। নেই অপারেশন থিয়েটারের তরল বর্জ্য ট্রিটমেন্ট। মেডিক্যাল বর্জ্য ও লন্ড্রি সার্ভিসের পানি ট্রিটমেন্টসহ বর্জ্য পরিশোধনাগার ব্যবস্থা নেই। এমনকি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানেরও পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। ফলে এই অপরিশোধিত মেডিক্যাল বর্জ্য থেকে মারাত্মক রোগব্যাধী ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। আবার ছাড়পত্র না থাকার অভিযোগে কোনো হাসপাতাল-ক্লিনিকের লাইসেন্স বাতিলেরও উদাহরণ নেই। অভিযোগ রয়েছে, পরিবেশ অধিদফতরের অসাধু কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে চলছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো।
সারা দেশে হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ব্লাড ব্যাংক ও প্যাথলজির সংখ্যা ২৩ হাজারের ওপরে। এর অর্ধেকই আছে খোদ রাজধানীতে, তার সংখ্যাও প্রায় ১২ হাজার। এর বাইরেও রাজধানীতে রেজিস্ট্রেশনহীন প্রতিষ্ঠান রয়েছে সহস্রাধিক। এদের মধ্যে ঢাকা মহানগরে ৩৩টি ও ঢাকা জেলার পাঁচটি উপজেলার মধ্যে পাঁচটিসহ ৩৮টির পরিবেশ ছাড়পত্র আছে। পরিবেশ ছাড়পত্র পাওয়া এই ৩৮ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৮টির কোনো ওয়াটার ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নেই। যদিও পরিবেশ ছাড়পত্রে ওয়াটার ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ডব্লিওডব্লিউটিপি) থাকা বাধ্যতামূলক।
এ বিষয়ে কথা হয় পরিবেশ অধিদফতরের ঢাকা মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক মাসুদ ইকবাল মো. শামীমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়ার কথা জানেন না অধিকাংশ হাসপাতাল-ক্লিনিকের মালিক।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টিও তাদের বিবেচনায় নেই। ইতোমধ্যে যাদের ছাড়পত্র নেই তাদের নোটিস দেওয়া হয়েছে। এই বাস্তবতায় আমাদের কার্যক্রম চলছে। কিন্তু জনবলের ঘাটতি আছে।’ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে বর্জ্য শোধনাগার থাকা বাধ্যতামূলক। পরিবেশগত পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭ অনুযায়ী হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিগুলোয় পরিবেশগত ছাড়পত্র নেওয়ার কথা থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা এ ব্যাপারে উদাসীন থাকছেন। তারা স্বাস্থ্য অধিদফতর ও পরিবেশ অধিদফতরের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাকে ‘ম্যানেজ’ করে চলছেন। বছর বছর মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ওই ‘অসাধু চক্র’। ফলে ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই চলছে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলো। ঢাকা জেলায় বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের কতকটিতে পরিবেশ ছাড়পত্র নেই, কতকটিতে নিজস্ব ‘ওয়াটার ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট’ (ডব্লিউডব্লিউটিপি) ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যকর রয়েছে, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানাতে পারেননি পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা। এসব চিকিৎসাকেন্দ্রে প্রতিদিন কী পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হয় তাও সংশ্লিষ্টরা জানাতে পারেননি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (ঢাকা মহানগর) আবুল কালাম আজাদ বলেন, এই মুহূর্তে সরকারি হাসপাতালের কোনো সঠিক তথ্য নেই। তবে বেসরকারিভাবে ৫০টি হাসপাতালের তালিকা আছে, যার মধ্যে ১৭টির ছাড়পত্র ও ৪০টির কোনো ওয়াটার ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ডব্লিওডব্লিউটিপি) নেই।
তিনি আরো জানান, মহানগরে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র প্রদান, শিল্প জরিপ, গুলশান খালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মনিটরিং ও অন্যান্য কাজের জন্য অর্গানোগ্রামে ৪০ জনের বিপরীতে মাত্র ১১ জন আছেন। একজন ম্যাজিস্ট্রেটের পদ থাকলেও সেটি দীর্ঘদিন শূন্য। ফলে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা যাচ্ছে না। ঢাকা জেলায় দায়িত্বে পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মিহির লাল সরদার জানান, তালিকা অনুযায়ী ১১ হাসপাতালের মধ্যে মাত্র পাঁচটি হাসপাতাল চলছে পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়া। এর কোনোটিতেই ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নেই। ২০টি নতুন হাসপাতালকে শনাক্ত করে নোটিস দেওয়া হয়েছে।
তবে সরেজমিনে গিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল, মিটফোর্ড, পঙ্গু হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি বড় সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রের একাধিক বর্জ্য অপসারণ কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘এসব হাসপাতালে রোগীদের ব্যবহৃত গজ, ব্যান্ডেজ, সুঁচ, ব্যাগ, প্যাকেট, সিরিঞ্জসহ প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৬০ কেজি ক্ষতিকর বর্জ্য তৈরি হয়। ছাড়াও ২০০ থেকে ২৫০ লিটার রক্ত, সিরামসহ তরল বর্জ্য উৎপন্ন হয়। কোনো কোনো দিন এর পরিমাণ আরো বেশি হয়ে থাকে।’
স্বাস্থ্য বিষেজ্ঞরা বলছেন, এসব ক্ষতিকর বর্জ্য সংক্রমিত হয়ে নানা ধরনের রোগবালাই ছড়াতে পারে। বিধিমালা অনুযায়ী তা সংরক্ষণ ও অপসারণে সাধারণ বর্জ্যরে জন্য কালো, ক্ষতিকারক বর্জ্যরে জন্য হলুদ, ধারালো বর্জ্যরে জন্য লাল, তরল বর্জ্যরে জন্য নীল, তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানো বর্জ্যরে জন্য সিলভার ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য সাধারণ বর্জ্যরে জন্য সবুজ রঙের ছয়টি পাত্র ব্যবহারের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সেখানে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ ভাগ উৎপন্ন বর্জ্যই রাস্তার পাশের খোলা ডাস্টবিন ও নর্দমায় ফেলা হয়। এ ছাড়া ২০০৮ সালে প্রণীত চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিধি অনুযায়ী সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক চালানোর জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র নিতে হলে ইফোলিয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) বা বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনসহ বর্জ্য ব্যবস্থপনা বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়।
রাজধানী চিকিৎসা বর্জ্য সংগ্রহে কাজ করছেন সিটি করপোরেশন ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা প্রিজম বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন। এ প্রতিষ্ঠানটির মনিটরিং কর্মকর্তা মো. মাহফুজুর রহমান জানান, চুক্তি অনুযায়ী সরকারি ২০টি ও বেসরকারি ৭৫৪টি হাসপাতাল এবং ক্লিনিক থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। সংগ্রহকৃত বর্জ্য হাসপাতালের মধ্যে স্কয়ার, আল-মানার ও প্রভা মেডিক্যাল সার্ভিসেস ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানেরই নিজস্ব ইটিপি প্লান্ট নেই। এসব চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে প্রতিদিন গড়ে সাত টন বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। বর্জ্য সংগ্রহ করার পর এগুলোকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে জীবাণুমুক্ত করা হয়। প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন উপকরণ প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহার করেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) অধ্যাপক ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসাইন বলেন, সারা দেশে ২৩ হাজারের ওপরে হাসপাতাল ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ব্লাড ব্যাংক ও প্যাথলজি আছে। বর্তমানে ঢাকা মহানগরের হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকগুলোর নতুন তালিকা প্রণয়নকাজ চলছে। তবে পরিবেশ অধিদফতর ও সিটি করপোরেশন সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না বলে মেডিক্যালের বিষাক্ত বর্জ্য থেকে পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে।
"