জুবায়ের চৌধুরী

  ১৯ আগস্ট, ২০১৭

অজ্ঞান পার্টি তৎপর অন্ধকারে পুলিশ!

গাজীপুরের শ্রীপুরে ব্যবসা করেন বাবুল আকন। প্রতি সপ্তাহে মাল কিনতে পুরান ঢাকার চকবাজারে যেতে হয়। সেদিনও তিনি গাজীপুর থেকে চকবাজারের উদ্দেশে গুলিস্তানের বাসে ওঠেন। এদিন তার কাছে ৬০ হাজার টাকা ছিল। বাসের যে সিটে তিনি বসে ছিলেন, তার পাশেই ৩০-৩২ বছরের এক যুবক ছিলেন। আলাপচারিতায় তাদের মধ্যে পরিচয় ঘটে। বাড়ে আন্তরিকতাও। তাদের বহন করা বাসটি টঙ্গীতে এসে যানজটে পড়ে।

একপর্যায়ে ওই যুবক বাস থেকে নেমে বাবুল ও নিজের জন্য দুটি কোল্ড ড্রিঙ্কস কেনেন। ব্যবসায়ী বাবুল সেই কোল্ডড্রিঙ্ক পানও করেন। এরপর আর কিছুই মনে নেই বাবুলের। তার যখন জ্ঞান ফেরে তখন তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন। অচেতন হওয়ার এক দিন পর জ্ঞান ফেরে বাবুলের। আগের দিন গুলিস্তানে অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে পুলিশ। পরে তারা হাসপাতালে ভর্তি করে। এভাবেই বাবুলের মতো শত শত লোক প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পরে সর্বস্ব খুইয়েছেন। সর্বশেষ গত শুক্রবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন মাসুদ আহমেদ (৪০) নামে এক ব্যক্তি। যাত্রাবাড়ীর সাদ্দাম মার্কেটের সামনের রাস্তায় অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে পুলিশ। পরে সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। নিহতের বাবার নাম আবদুল হামিদ। তার বাড়ি হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার জালালসাহেব গ্রামে। পুলিশ বলছে, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা তাকে মেরে ফেলে রেখে গেছে।

হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, চলতি মাসে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ৪০ জনেরও বেশি। তবে কোরবানির ঈদের সময় এ সংখ্যাটা আরো বাড়বে। সাধারণত ঈদ ঘিরে যানবাহন, বাস স্টপেজ, লঞ্চঘাট, রেল স্টেশনসহ বিভিন্ন স্পটে অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা বেড়ে যায়। তবে কোরবানির ঈদে পশু বিক্রেতাদের টার্গেট করে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। এদিকে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে রাজধানীতে গ্রেফতার হয়েছেন অজ্ঞান পার্টির প্রায় অর্ধশত সদস্য। ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, ঈদে অজ্ঞান পার্টি-মলম পার্টির দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। তাই এ সময়টাতে পুলিশি তৎপরও বাড়ানো হয়। নাগরিকদের সচেতন করতে নানা কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে। যাত্রাপথে অপরিচিত লোকের সঙ্গে সখ্য গড়ে না তোলা ও তাদের দেওয়া খাবার পরিহার করলে অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। নগরবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, কারো হাতে রুমাল দেখলে সতর্ক থাকুন। কারণ, রুমালের মধ্যে ক্লোরোফর্ম মিশিয়ে নাকের কাছে ধরলে যে কেউ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। সচেতনতাই অজ্ঞান পার্টির হাত থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র উপায়।

এদিকে, অজ্ঞান পার্টির অর্ধশতাধিক হোতাকে গ্রেফতার করতে মাঠে নেমেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ অসাধু চক্র চেতনানাশক ওষুধসামগ্রী কিনে এমন শতাধিক ওষুধের দোকানেরও তালিকা করা হয়েছে। ওইসব ওষুধ বিক্রেতার বিরুদ্ধেও অভিযানের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ওই সব দোকানের বেশির ভাগই বড় বড় হাসপাতালকেন্দ্রিক। মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ১৫-২০টি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে ৪টি এবং পঙ্গু, সোহরাওয়ার্দী ও হৃদরোগ হাসপাতালকেন্দ্রিক ১০-১২টি ওষুধের দোকান আছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, অজ্ঞান পার্টির একটি ‘অপারেশনে’ তিন থেকে চারজন সদস্য থাকে। কখনো কখনো এ সংখ্যা ১০-১২ জন বা ১৫-২০ জনও হতে পারে। চক্রের একটি গ্রুপ নগরীর ব্যস্ততম স্থানে ডাব, কোমল পানীয়, আচার, ঝালমুড়ি, ফলমূল, চানাচুর ভাজা, শসা, খেজুর, আম, সিগারেট, পান, জুসসহ নানা খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করে। অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা ক্রেতা সেজে সেখানে গিয়ে সাধারণ ক্রেতাদের আকৃষ্ট করেন। টার্গেট ব্যক্তির কাছে চেতনানাশক মেশানো পণ্যটি বিক্রি করার পর ওই ক্রেতাকে গভীরভাবে অনুসরণ করা হয়। ওই ব্যক্তিটি অচেতন হতেই অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা সব হাতিয়ে নেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে টার্গেট ব্যক্তির স্বজন সেজে হাসপাতালে নেওয়ার নাম করে পথেই সর্বস্ব লুটে নেয়। আবার ছদ্মবেশী হকাররা কবিরাজি পণ্য, আচার, চকোলেট প্রভৃতি বিক্রির নাম করেও সর্বস্ব লুটে নেয়। তারা প্রচারের জন্য প্রথমে ফ্রি খাওয়ার অফার দেয়। অন্য যাত্রীদের স্বাভাবিক খাবার দিলেও টার্গেট করা ব্যক্তিকে দেওয়া হয় চেতনানাশক মেশানো খাবার।

পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা জানিয়েছে, তারা টার্মিনাল বা স্টেশনে তাদের একাধিক সদস্য অন্য যাত্রীদের সঙ্গে টিকিট কাটতে লাইনে দাঁড়ায়। সাধারণ যাত্রীরা যখন মানিব্যাগ বের করে তখন তারা মানিব্যাগের দিকে নজর দেয়। তারা দেখে, ব্যাগে মোটা অঙ্কের টাকা আছে কি না। যখন কারো ফোন আসে তখন টার্গেট ব্যক্তির মোবাইল ফোনের দিকে নজর দেয়। দেখে নেয়, ফোনটি দামি কি না। সঙ্গে থাকা ব্যাগে ল্যাপটপ বা দামি কোনো কিছু আছে কি না। পরে টার্গেট করা ব্যক্তির পাশে, সামনে বা পেছনের সিটে টিকিট কাটে তারা। এরপর ওই যাত্রীর সঙ্গে গাড়িতে ওঠে তার সঙ্গে খোশগল্পে মেতে ওঠে। এরপর নানা কৌশলে চেতনানাশক খাইয়ে দেয়। আর সর্বস্ব লুটে নিয়ে চম্পট দেয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist