হাসান ইমন
যাত্রী ছাউনি দখলে দুর্ভোগে পথচারী
রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন (উত্তর ও দক্ষিণ) এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের কাগজে-কলমে ২৩০টি যাত্রী ছাউনি থাকলেও অধিকাংশই ব্যবহার অযোগ্য। অনেকগুলোর নিশানাও নেই। আবার বেশির ভাগ যাত্রী ছাউনি দখল করে গড়ে উঠেছে অবৈধ বাণিজ্য। এলাকায় যাত্রী ছাউনি থাকলেও সেখানে বাস থামে না। এতে রোদ-বৃষ্টি, শীত বা গরম কোনো সময়েই স্বস্তি নেই ঢাকায় গণপরিবহনের যাত্রী এমনকি পথচারীদেরও। ফলে বৃষ্টি হলেই পানিতে ভিজতে হয়। আবার প্রখর রোদেও মাথার ওপর মেলে না এক চিলতে ছাদ। সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবেই নগরবাসীর এমন করুণ হাল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামছুল হক অধ্যাপক সামছুল হক জানান, যাত্রীদেরকে যাত্রী ছাউনিতে রোদ-বৃষ্টিতে প্রটেকশান দিতে ছাউনি-ভিত্তিক বাস সার্ভিস দেওয়া। এই জিনিসগুলো কিন্তু করার জন্য বলা হচ্ছে। এটার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান দরকার ছিল। শুধু রোড পারমিট দিয়ে কোনো কাজ হয় না। রোদ-বৃষ্টির কথা মাথায় রেখে দ্রুত আধুনিক ছাউনি নির্মাণে নগর কর্তৃপক্ষকে আরো বেশি উদ্যোগী হওয়া এবং যাত্রীসেবার মান বাড়াতে ছাউনিগুলোকে যাত্রীবান্ধব করার পরামর্শ দিলেন এই বিশেষজ্ঞ।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, যাত্রী ছাউনিগুলো যা-ও আছে তা যাত্রীরা ব্যবহার করতে পারছে না। এগুলো মার্কেটে পরিণত হয়েছে। সিটি করপোরেশনের তদারকির অভাবে দিন দিন এগুলো নষ্ট হচ্ছে।
উত্তর সিটির সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে তাদের সীমানা এলাকায় যাত্রী ছাউনি রয়েছে ১২৯টি। এর মধ্যে ৯৬টি সিটি করপোরেশনের। আর সড়ক ও জনপথ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) ও অন্যান্য সংস্থার অনুমোদিত যাত্রী ছাউনি রয়েছে ১৫টি। এসব যাত্রী ছাউনির মধ্যে ব্যবহারের জন্য ৭৭টিই মেয়াদোত্তীর্ণ। এর মধ্যে চুক্তি নবায়ন হয়েছে ৬১টির। আর সংস্কারযোগ্য যাত্রী ছাউনি রয়েছে ১০টি। এ ছাড়া উচ্ছেদযোগ্য ১৩টি যাত্রী ছাউনি রয়েছে।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, সিটি করপোরেশন বিভক্ত হওয়ার পর দক্ষিণ সিটি এলাকায় ৮৬টি যাত্রী ছাউনি ছিল। এর মধ্যে একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানিকে ৫৭টি যাত্রী ছাউনি ইজারা দেওয়া হয়। তারা ৩২টি যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করেছে। বাকিগুলো করতে পারেনি। এ ছাড়া অন্য বেসরকারি কোম্পানি আরো ২৯টি যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করে। মোট ৬১টি যাত্রী ছাউনি ২০০৭ সালে চুক্তির মাধ্যমে পাঁচ বছর মেয়াদে বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা ২০১২ সালে শেষ হয়েছে। এরপর ডিএসসিসি নতুন করে কোনো যাত্রী ছাউনি নবায়ন বা অনুমোদন দেয়নি। ফলে সংস্থাটির সবগুলো যাত্রী ছাউনি মেয়াদ উত্তীর্ণ।
এই বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, যাত্রী ছাউনিগুলো দীর্ঘদিন আগে তৈরি করায় বেশ কয়েকটি যাত্রী ছাউনি ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ে আছে। এসব যাত্রী ছাউনি যাত্রীদের তেমন কোনো কাজে আসছে না। আগামীতে ঢাকার পরিবহন পরিকল্পনার সঙ্গে মিল রেখে জরিপ করে যেসব স্থানে নতুন জায়গায় ছাউনি নির্মাণ করা প্রয়োজন সেসব স্থানে নতুন করে যাত্রী ছাউনি তৈরি করা হবে।
দুই সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনের যাত্রী ছাউনিতে একজন রীতিমতো হেঁশেল বানিয়ে ভাজাপোড়া খাবার বিক্রি করছে। যাত্রীদের দাঁড়ানোর স্থান নেই। সিরামিকের তৈরি বসার জায়গা থাকলেও উপরে ছাদ নেই ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের উল্টো দিকের যাত্রী ছাউনিতে। সেখানে এক ভবঘুরে তিনটি বেওয়ারিশ কুকুর নিয়ে রাতদিন শুয়ে-বসে থাকে। পথচারীরা এই কুকুরের ভয়ে অনেক সময় ফুটপাত ছেড়ে মূল সড়ক দিয়ে হাঁটতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন। শাহবাগে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব যাত্রী ছাউনিটি ফার্মেসির দখলে। গুলিস্তানে স্টেডিয়ামের উল্টো দিকে বাস স্টপেজের সামনের যাত্রী ছাউনির পুরোটাই হকারদের দখলে। যাত্রী বসার ব্যবস্থা তো দূরের কথা, দোকানিদের দাপটে হাঁটা-চলায়ই দায়। বসার জায়গা নেই শেওড়া বাসস্ট্যান্ডের দুটি ছাউনি ও আবদুল্লাহপুর যাওয়ার পথে বিমানবন্দর বাস স্টপেজের সামনের ছাউনিতে। গ্রাফিক আর্টস এন্ড ইনস্টিটিউটের পাশের ছাউনিতে একটি ড্রাইভিং শেখার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে তাদের ঠিকানা। মিরপুর বাংলা কলেজের সামনের যাত্রী ছাউনিটিতে বসলে দুর্গন্ধে টেকা যায় না।
এ ছাড়া ফার্মগেট থেকে শাহবাগে যেতে শাহবাগ মোড়ে যাত্রী ছাউনি থাকলেও বাংলামোটরের কোনো স্থানেই কোনো যাত্রী ছাউনি নেই। অথছ নিয়মিত সব বাস থামানো হয় সেখানে। কাওরান বাজার ও ফার্মগেটের মাঝামাঝি একটি ছাউনি থাকলেও সেখানে বাস থামে না কখনোই। ফলে যাত্রীদের কোনো উপকারেই আসছে না এটি।
ভুক্তভোগী সালমা বেগম জানান, ‘দাঁড়াইয়া রইছি বাচ্চা নিয়া। এইভাবে বৃষ্টি হলে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব। দুই ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি। যাত্রী ছাউনি তো নেইই। কোথাও দাঁড়িয়ে যে নিজেকে রক্ষা করব এ ব্যবস্থাও নেই’। তিনি বলেন, খিলক্ষেতের মতো এমন ব্যস্ততম জায়গায় একটি যাত্রী ছাউনি থাকা উচিত ছিল।
"