শরীফুল রুকন, চট্টগ্রাম

  ১৭ আগস্ট, ২০১৭

অস্ত্রের উৎস খুঁজে পায় না পুলিশ, দুর্বল মামলা

চট্টগ্রামে অস্ত্র ও গুলি উদ্ধারের পর তদন্ত শেষে দেওয়া হচ্ছে অভিযোগপত্র। তবে বেশির ভাগ অভিযোগপত্রের ভাষা প্রায় একই ধরনের। অভিযোগপত্রে অস্ত্র ও গুলিসহ আটক ব্যক্তিদের বাইরে অন্য কাউকে আসামি করা হচ্ছে না। কার কাছ থেকে অস্ত্র এসেছে, কোথায় যাবে বা কে অর্থের জোগান দিয়েছেÑ সেই রহস্য বের করতে পারছে না পুলিশ। অস্ত্র পাচারে জড়িত সংঘবদ্ধ চক্রগুলোর কার্যক্রম, এর প্রধান ব্যক্তি কারা, সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য থাকছে না অভিযোগপত্রে। এতে মামলা দুর্বল হয়, সহজেই খালাস পান আসামিরা।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চট্টগ্রাম বিভাগের প্রচার সম্পাদক মামুনুল হক চৌধুরী বলেন, ‘সঠিক তদন্ত হলে উৎসের কাছে যেতে না পারলেও গ্রেফতার ব্যক্তি কার কাছ থেকে অস্ত্র পেয়েছে, তা অন্তত উঠে আসার কথা। তবে অস্ত্র দিয়ে মামলায় ফাঁসানো হলে উৎস খুঁজে পাওয়ার কথা নয়। আবার অস্ত্র মামলায় রিমান্ডে এনে ম্যানেজ হয়ে গেলে তো উৎসের কাছে যাওয়া সম্ভব না।’ পুলিশের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম মহানগরের ১৬ থানায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত অস্ত্র আইনে ১৩৩টি মামলা হয়েছে; মে মাসে সর্বোচ্চ ২৭টি মামলা রেকর্ড হয়।

আদালতে দাখিল করা অন্তত ১৫টি অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তাতে অস্ত্র চোরাচালানে জড়িত সংঘবদ্ধ চক্রগুলোর কার্যক্রম ও উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও গুলির উৎস উঠে আসেনি। গত ৭ মার্চ চট্টগ্রাম নগরের ডবলমুরিং থানার দাইয়াপাড়া এলাকা থেকে পাকিস্তানে তৈরি অস্ত্র ও পাঁচ রাউন্ড কার্তুজসহ গ্রেফতার হন তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী গোলজার আলম। তাকে গ্রেফতারের পর ১৩ মার্চ পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করে তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ডবলমুরিং থানার এসআই আল-আমীন। সে সময় রিমান্ডের আবেদনে তদন্তকারী কর্মকর্তা যুক্তি দেন, উদ্ধারকৃত অস্ত্রের উৎস-সংক্রান্তে তথ্য সংগ্রহ, আসামির অপরাধ প্রক্রিয়া-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ, অস্ত্র সরবরাহ ও ঘটনার নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য রিমান্ডের প্রয়োজন। এরপর একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ড শেষে গোলজারকে আদালতে হাজির করে ১৯ মার্চ প্রতিবেদন জমা দেন এসআই আল-আমীন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, আসামি একজন পেশাদার অপরাধী। তার সঙ্গে থাকা অন্য আসামিদের নাম-ঠিকানা ও তাদের অস্ত্র-কার্তুজ সম্পর্কে সে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। গোলজার তার হেফাজত থেকে উদ্ধার অস্ত্র-কার্তুজের উৎস-সংক্রান্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেছেন রিমান্ডে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

এরপর এই মামলায় ২৮ মার্চ আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। সেখান অস্ত্রসহ আটক গোলজারকে আসামি করেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এতে ঘটনার সময় গোলজারের সঙ্গে থাকা অজ্ঞাতনামা আসামি ছাড়াও অস্ত্র পাচার চক্রের অন্যরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে। অথচ গোলজারকে রিমান্ডে এনে সন্দেহভাজনদের নাম ও তথ্য পাওয়া গেছে বলে আদালতকে জানিয়েছিল পুলিশ।

এদিকে, ২০০৫ সালের ১৪ এপ্রিল চট্টগ্রাম নগরের সাগরিকা এলাকা থেকে একটি দেশীয় তৈরি এলজি ও ইটালির তৈরি কার্তুজসহ রানা ও মোতালেব নামের দুইজনকে গ্রেফতার করে পাহাড়তলী থানা পুলিশ। এ ঘটনায় আসামিদের দুই দিন রিমান্ড শেষে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে এসআই সফিকুল ইসলাম বলেন, আসামিদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। অথচ ২৯ এপ্রিল জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে নতুন কোনো তথ্য দিতে পারেননি তদন্তকারী কর্মকর্তা; এ ঘটনায় হাতেনাতে আটক দুইজন ছাড়া অন্য কোনো আসামির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি। অর্থাৎ এজাহারের তথ্যের বাইরে অভিযোগপত্রে নতুন কোনো তথ্য নেই। মামলাটি এখনো বিচারাধীন।

এভাবে অস্ত্রধারী পর্যন্ত তদন্ত সীমাবদ্ধ থাকাকে পুলিশের অদক্ষতা ও দায়িত্বশীলতার অভাব হিসেবে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি রতন কুমার রায়। তিনি বলেন, ‘একটি বিদেশি অস্ত্র তো উড়ে বাংলাদেশে আসে না। অস্ত্র ও গুলি পাচারের সঙ্গে সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত, এটি সর্বজনবিদিত। তাছাড়া দেশে তৈরি অস্ত্রের উৎস খুঁজে বের করা তো কঠিন কিছু না। এখন পুলিশ অস্ত্রসহ ধরে উৎসের কাছে যাচ্ছে না কেন সেটা রহস্যজনক। দেশের স্বার্থে পুলিশের উচিত হবে প্রতিটি অস্ত্র ও গুলির উৎস খুঁজে বের করা।’

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) সালেহ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘অস্ত্রধারীরা অস্ত্রের উৎস সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে না পারায় সে বিষয়ে তথ্য উঠে আসছে না। এ ছাড়া হাতেনাতে অস্ত্র আটক হলে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে অভিযোগপত্র দিতে হয়। দ্রুত অভিযোগপত্র দিতে হয় বলে তদন্তে প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারেন না কর্মকর্তারা। যার কারণেও হয়তো অস্ত্রের উৎসের তথ্য উঠে আসছে না। তবে নতুন তথ্য পাওয়া গেলে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।’

চট্টগ্রাম মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ফখরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘দক্ষতার সঙ্গে তদন্ত করে অস্ত্র ও গুলির উৎসের কাছে গিয়ে মূল ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তা না হলে অস্ত্র পাচার নিয়ন্ত্রণ হবে না। এ ছাড়া দুর্বল অভিযোগপত্রের কারণে কিছু কিছু মামলার যথার্থ বিচার হয় না। আসামি খালাস পেয়ে যায়।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist