হাসান শান্তনু

  ১৪ আগস্ট, ২০১৭

চাকরির নীতিমালা নেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে

চাকরির সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছাড়াই চলছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছে ২৪ বছর ধরে। এখনো সেখানে তৈরি হয়নি চাকরির বিধিমালা। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগে চলছে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা। যখন তখন চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটছে অহরহ। সরকারি আইনে যতটুকু বিধিমালার উল্লেখ আছে তাও মানছে না সেখানকার কর্তৃপক্ষ।

এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের নিয়োগ ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে হয়ে থাকে। নীতিমালা না থাকায় কোনো ধরনের নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করে না ওই বোর্ড। নিয়োগকৃতদের চাকরির নিশ্চয়তা নেই। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা থাকেন চাকরি হারানোর আতঙ্কে। মেধা, যোগ্যতা ও মানের চেয়ে মুনাফা এবং আনুগত্যতাকেই বিবেচনা করে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ কারণে সেখানে মানসম্পন্ন শিক্ষক সংকট রয়েছে। এ জন্য মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষাও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

বিদ্যমান ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০’ অনুযায়ী সব প্রতিষ্ঠানে পূর্ণকালীন শিক্ষক বেশি থাকার কথা স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। শিক্ষক নিয়োগের এ আইনও মানছে না অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় খ-কালীন শিক্ষক ও প্রভাষকনির্ভর। কম টাকায় খণ্ডকালীন শিক্ষক রাখা যায় বলে পূর্ণকালীন শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছেন না উদ্যোক্তরা। এতে কয়েক লাখ টাকা খরচ করে সনদপত্র অর্জন করেও মানসম্পন্ন শিক্ষা পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা। পূর্ণকালীন শিক্ষক বেশি রাখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশ মানছে না অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। শিক্ষকের অভাবে সেগুলো নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে পারছে না।

ইউজিসি বিষয়টি স্বীকার করে বলছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির নীতিমালা করার কাজ চলছে। নির্দিষ্ট নিয়মকানুন ও যোগ্যতাকে বাধ্যতামূলক করে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগে বিধিমালা প্রণয়ন করতে যাচ্ছে ইউজিসি। প্রতিটি স্তরে নিয়োগের বাধ্যতামূলক যোগ্যতা, নিয়োগের শর্ত, বেতন কাঠামো ও পদোন্নতির স্তর বিন্যাস এতে সংযুক্ত করা হবে। এ ছাড়া অবসর সুবিধাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের বিধানও থাকবে এতে। এমন একটি খসড়া নিয়ে ইউজিসি কাজ শুরু করেছে কিছুদিন থেকে। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) শিক্ষক ও কর্মচারীদের নিয়োগের বিদ্যমান নীতিমালার আলোকে এটি প্রণীত হচ্ছে। এরপর প্রস্তাবিত খসড়াটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়া গেলে পরে ইউজিসি বিধিমালাটি প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করবে। জারিকৃত প্রজ্ঞাপনটি সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবশ্য পালনীয় হিসেবে চিহ্নিত হবে। এ প্রসঙ্গে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। এর ধারাবাহিকতায় শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সুবিধার্থে একটি নিয়োগবিধি তৈরির কাজ চলছে।’

এদিকে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি বলছে, ইউজিসির চাকরি বিধিমালা করায় আপত্তি নেই। তবে সমিতির নেতাদের দাবি, সব পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে করতে হবে বিধিমালা। বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেনের কাছে জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘দেশে শিক্ষকের সংকট আছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাইলেও সবক্ষেত্রে যোগ্য শিক্ষক পাচ্ছে না। মানসম্মত শিক্ষক তৈরি করতে পারলে এ সংকট অনেকটা কমে আসবে।’

সূূত্র জানায়, সামান্য কারণে চাকরিচ্যুত হওয়ার অর্ধশতের বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে ইউজিসিতে। আইনি সীমাবদ্ধতায় কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না মঞ্জুরি কমিশন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেও অবসরের সময় খালি হাতে বিদায় নিতে হচ্ছে। এখানে শিক্ষকদের পদোন্নতির নীতিমালা নেই। নেই কোনো বেতন স্কেল, ইচ্ছামতো বেতন নির্ধারণ, যথোপযুক্ত কারণ ছাড়া চাকরিচ্যুত, অর্থ আদায়ের মাধ্যমে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ এবং ট্রাস্টি বোর্ড সদস্যদের মনোনীতদের নিয়োগে অগ্রাধিকার, তাদের অযাচিত হস্তক্ষেপে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না বলে শিক্ষকদের অভিযোগ।

তথ্যমতে, ঢাকার সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয় থেকে গত মার্চ মাসে চাকরি হারান রাজনীতি ও প্রশাসনবিজ্ঞান, বাংলা ও আইন বিভাগের পাঁচ শিক্ষক। তাদের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতের মিল না হওয়ায় চাকরিচ্যুত করা হয়। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে গত মাসের শেষদিকে এক প্রভাষককে নিয়মবহির্ভূতভাবে চাকরিচ্যুতির অভিযোগের পর আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। এক সপ্তাহের অচলাবস্থার পর চাকরিতে পুনর্বহাল হন ওই শিক্ষক। এ ঘটনায় নতুন করে সামনে আসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির সমন্বিত নীতিমালা না থাকার বিষয়টি। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শিক্ষক ফারহান উদ্দিন আহমেদকে গত ৩০ জুলাই মানবসম্পদ বিভাগ থেকে চাকরিচ্যুতির নোটিস দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি তা নিতে অস্বীকৃতি জানালে রেজিস্ট্রার বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা তার আইডি কার্ড নিয়ে নেন ও তাকে লাঞ্ছিত করেন। এরপর শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার শাহুল আফজালকে দীর্ঘ মেয়াদে ছুটি দেওয়া হয়। শিক্ষক ফারহানের অব্যাহতিপত্রও প্রত্যাহার করা হয়। এ ছাড়া শিক্ষককে লাঞ্ছনার অভিযোগে অভিযুক্ত সহকারী রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ মাহিউদ্দিন ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জাভেদ রাসেল পদত্যাগ করেন।

ইউজিসির তথ্যমতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক আছেন ১৫ হাজার ৫৮ জন। তাদের মধ্যে পূর্ণকালীন ১০ হাজার ১৮৮ ও খন্ডকালীন চার হাজার ৮৭০। কয়েকজন শিক্ষাবিদ জানান, আইন অনুযায়ী, একটি প্রতিষ্ঠানের কোনো বিভাগে খন্ডকালীন শিক্ষক পূর্ণকালীন শিক্ষক সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি হবে না। ইউজিসির সবশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, নর্থ সাউথ, ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (আইইউবি) ও ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির মতো প্রথম সারির প্রতিষ্ঠানে খন্ডকালীন শিক্ষক পূর্ণকালীনের দ্বিগুণের বেশি।

২০১৫ সালে নর্থ সাউথ, আইইউবি ও ইস্ট ওয়েস্টে মোট ছিলেন এক হাজার ৯৬৮ শিক্ষক। তাদের মধ্যে পূর্ণকালীন ৭৭৬ জন ও খন্ডকালীন এক হাজার ১৯২ জন। বিশ্ববিদ্যালয় তিনটিতে খন্ডকালীন শিক্ষকের সংখ্যা ৬০ শতাংশের বেশি। ২০১৫ সালে নর্থ সাউথে পূর্ণকালীন ৪২৫, খন্ডকালীন ৮৯৯ জন; আইইউবিতে পূর্ণকালীন ১৫৪ জন, খণ্ডকালীন ১৫০ জন এবং ইস্ট ওয়েস্টে পূর্ণকালীন ১৯৭ জন ও খন্ডকালীন ১৪৩ জন ছিলেন। ১৯৯৩ সালে যাত্রা শুরু করে দেশে ৯৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী প্রায় দুই লাখ। এ ছাড়া প্রায় পাঁচ হাজার কর্মকর্তা ও সাত হাজার কর্মচারী আছেন।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
চাকরির নীতিমালা,বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়,শিক্ষা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist