জিন্নাতুল ইসলাম জিন্না, লালমনিরহাট
ছেলের পায়ে ‘নির্দয়’ শিকল নিরুপায় মা-বাবার
সাইফুল ইসলাম। বয়স ১০ বছর প্রায়। ছোটবেলায় মাত্র দুই বছর বয়সে একদিন খেলতে গিয়ে মাথায় প্রচন্ড আঘাত পায় সে। এর পর থেকেই সে অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। তখন থেকেই বাবা-মা বুঝতে শুরু করেন ছেলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী।
তারপর একে একে কেটে যায় আটটি বছর। বয়সের সঙ্গে বাড়তে থাকে সাইফুলের দুরন্তপনাও। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে ছেলেকে নিয়ে বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তা। তাই ছেলেকে চোখের সামনে রাখতে তারা বেছে নেন এক ‘নির্দয়’ পথ। দুই পায়ে শিকল পরিয়ে বাড়িতেই বেঁধে রাখা হয় সাইফুলকে। দুই বছর ধরে এভাবেই পায়ে শিকল থাকার কারণে লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে হয় তাকে। চোখের সামনে প্রতিনিয়ত ছেলের এমন কষ্ট দেখেও অনেকটা নিরুপায় হয়েই সবকিছু মেনে নিচ্ছেন সাইফুলের বাবা-মা। তাদের বাড়ি লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের বালাপাড়া গ্রামে। ওই এলাকার আশরাফুল ইসলাম ও ছালেহা বেগম দম্পতির ছেলে সাইফুল ইসলাম।
শাড়ির আঁচলে চোখের পানি মুছতে মুছতে সাইফুলের মা ছালেহা বেগম বলেন, ‘মুই ওর মাও। মোর ছাওয়াক শিকলে বান্ধা দেখতে মোর চেয়ে বেশি কষ্ট আর কার নাগবে কন!’ এরপর তিনি জানান, দুই বছর বয়সে খেলতে গিয়ে মাথায় প্রচ- আঘাত পায় সাইফুল। ওই সময় ডাক্তারের পরামর্শে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘদিনের চিকিৎসায়ও সুস্থ হয়নি সে। এদিকে ছেলের চিকিৎসায় সর্বস্ব বিক্রি করে নিঃস্ব বাবা-মা। জমি-টাকা সব শেষ, তবু শেষ হয়নি ছেলের চিকিৎসা। টাকার অভাবে বন্ধ হয়ে যায় সাইফুলের চিকিৎসা। এদিকে প্রায়ই বাড়ি থেকে দূর-দূরান্তে চলে যেত সাইফুল। অনেক কষ্টে বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করে তাকে খুঁজে পাওয়া যেত। ফলে বাধ্য হয়ে তার দুই পায়ে শিকল বেঁধে ঘরের ভেতর আটকে রাখা হয়েছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া তাকে বাইরে বের করা হয় না।
সাইফুল ইসলামের চাচা জিয়া ইসলাম বলেন, ‘যতই অসুস্থ বা পাগল হোক, ছেলে তো আমাদের। ওকে না দেখলে ওর বাবা-মা ও আমাদের রাতে ঘুম আসে না। সাইফুল যেন দূরে কোথাও গিয়ে হারিয়ে না যায়, সেই ভয়ে ওর পায়ে শিকল বাঁধা হয়েছে। যদি ওকে শিকল দিয়ে বাঁধা আমাদের অপরাধ হয়, তাহলে আমাদের ছেলে বাইরে কোথাও হারিয়ে গেলে বা কোনো দুর্ঘটনার শিকার হলে তখন কী হবে?’
ওই এলাকার ইউপি সদস্য আব্দুল মজিদ জানান, সাইফুল নিজের নাম, বাবা-মায়ের নামসহ অনেক কিছুই বলতে পারে। শিশুটির সঠিক চিকিৎসা করানো হলে সে সুস্থ হয়ে উঠবে। এ জন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। এ বছর প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য তার নাম তালিকায় পাঠানো হয়েছে। সাইফুলের বাবা আশরাফুল ইসলাম নিজেও একজন প্রতিবন্ধী।
আদিতমারী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কাশেম আলী বলেন, একটি শিশুর পায়ে সব সময় শিকল পরিয়ে রাখা খুবই অমানবিক কাজ। তবে যতটুকু পারা যায় তাকে চোখে চোখে রাখতে হবে।
আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসাদুজ্জামান জানান, শিশুকে শিকল পরিয়ে রাখা খুবই দুঃখজনক। তার উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন হলে চিকিৎসা করানো উচিত। খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করা হবে।
"