পোশাক কারখানার প্ল্যানিং ম্যানেজারের চাকরি হারিয়ে রাজিব হাসান এখন ফেসবুকের মাধ্যমে বিক্রি করছেন সরিষার তেল আর মধু; পেশাদার আলোকচিত্রী সৌরভ শেখ বিক্রি করেন শাড়ি। গ্র্যাফিক ডিজাইনার মাহফুজা মৌ অনলাইনে নিচ্ছেন খাবারের অর্ডার। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর গত পাঁচ মাসে অনেকের জীবনই পাল্টে গেছে। বিশেষ করে করোনা সংকটের কারণে যারা কাজ হারিয়েছেন, তাদের কাছে জীবন এখন অন্য এক লড়াইয়ের নাম।

‘দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার’ মতো অবস্থায় থেকেও প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তিতে ভর করে জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে নিয়েছেন চাকরি হারানো কয়েকজন তরুণ। তারা নিজেরাই এখন উদ্যোক্তা।

অনলাইন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে ছোট পরিসরে যে ব্যবসা তারা শুরু করেছিলেন, এই কয়েক মাসের মধ্যেই তারই পরিসর বাড়ানোর কথা ভাবছেন তারা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও চাকরিতে ফেরার আর ইচ্ছা নেই তাদের। এক সময় ক্যামেরা হাতে ছুটে বেড়ানো সৌরভ শেখ এখন ব্যবসায়ী। ‘পার্বণ’ নামে তার ফেসবুক পেজে মিলবে জামদানি, তাঁতের শাড়িসহ নানা পণ্য। সৌরভ শেখ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতক করার পাশাপাশি ২০১৮ সালে ফটোগ্রাফি কোর্স করেছিলেন। পরের বছর ডিসেম্বরে জাপানি একটি কোম্পানিতে ফটোগ্রাফারের চাকরিও জুটে যায়। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় এপ্রিলে প্রতিষ্ঠান তাকে কাজ বন্ধ রাখতে বলে।

কাজ খোয়ানোর সেই কঠিন মুহূর্তগুলো কেমন ছিল? স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী সৌরভ বলেন, এমন পরিস্থিতিতে যদি জবটা ছেড়ে দিতে হয় তাহলে চলা খুব কঠিন হয়ে পড়বে। তাই অফিসকে জানালাম, বাইরে গিয়ে কাজ করতেও সমস্যা নেই। কর্তৃপক্ষ জানাল- হয় অপেক্ষা করেন, না হয় চাকরি ছেড়ে দেন। বেতন দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।

এভাবে এক মাস কেটে গেলেও প্রতিষ্ঠানের সাড়া না পেয়ে চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। খুব কঠিন সময় যাচ্ছিল। তখন লকডাউন। কাজের জন্য বের হওয়াও সম্ভব ছিল না সেই সময়টায়। ঠিক করলাম, এ কঠিন অবস্থায় যারা কর্মীদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করে, তাদের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করব না। আর তারা তো আমাকে কাজ বন্ধ রাখতেও বলেছিল।

শৈশব থেকেই নিজে কিছু করার ইচ্ছা ছিল সৌরভের, চাকরি হারানোর পর সেই স্বপ্ন নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেন। ঠিক করলেন, অনলাইনে শাড়ির ব্যবসা করবেন। প্রস্তুতি নিলাম। ৬ জুন ফেসবুকে ‘পার্বণ’ নামে একটি পেজ খুলে জামদানি ও তাঁতের শাড়ি বিক্রি শুরু করি। শুরুর কয়েক দিন একেবারেই সাড়া পাইনি। প্রথম শাড়ি বিক্রি হয় ১৮ জুন। পরিচিত এক বড় ভাই তার মা ও বোনের জন্য দুটি শাড়ির অর্ডার করেন। এখান থেকেই শুরু। এরপর থেকে ভালোই অর্ডার পাচ্ছি।

১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায় জামদানি শাড়ি বিক্রি করেন সৌরভ। ফটোগ্রাফার থেকে ব্যবসায়ী বনে যাওয়া সৌরভ বলেন, বাঙালি প্রায় সব নারীরই শখ থাকে, তার একটা জামদানি শাড়ি থাকবে। কিন্তু দাম বেশি হওয়ায় অনেক সময় তা কেনা হয়ে ওঠে না। তাই একটু কম রেঞ্জে জামদানি আনলাম আমি। সঙ্গে তাঁতেরও কিছু শাড়ি আনলাম।

এরপর সুপারি পাতার খোল দিয়ে তৈরি ওয়ানটাইম প্লেট, মাদুর, মোয়া, নাড়ুও বিক্রি শুরু করেন তিনি। ঢাকার দক্ষিণ বনশ্রীর বাসিন্দা এই তরুণ বলেন, চাকরি হারিয়ে যখন দিশেহারা তখন ঠিক করেছিলাম, সফল না হয়ে এই শহর ছাড়ব না। নিজে কিছু করে মাথা উঁচু করেই বাঁচব।

আর চাকরিতে ফিরতে চান না রাজিব হাসান। অনলাইন প্ল্যাটফরমে খাঁটি সরিষার তেল আর মধু বিক্রির ব্যবসাটা ধীরে ধীরে বড় করার ইচ্ছা তার। আর চাকরিতে আর ফিরতে চান না রাজিব হাসান। অনলাইন প্ল্যাটফরমে খাঁটি সরিষার তেল আর মধু বিক্রির ব্যবসাটা ধীরে ধীরে বড় করার ইচ্ছা তার। পোশাক খাতে রাজিব হাসানের অভিজ্ঞতা এক দশকেরও বেশি। তারপরও তাকে চাকরি হারাতে হয়েছে মহামারিকালে।

রাজিব সবশেষ ছিলেন গাজীপুরের মাওনার একটি কারখানার প্ল্যানিং ম্যানেজার। করোনাভাইরাসের কারণে সাধারণ ছুটির পর অর্ডার না পাওয়ার অজুহাতে তাকে চাকরিতে রাখা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়ে দেয় প্রতিষ্ঠান। আমার মতো সিনিয়র পোস্টে থাকা অনেকেরই চাকরি চলে গেল। খুব সংকটে পড়ে যাই, দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে কীভাবে চলবে, ভেবে কূল পাচ্ছিলাম না, দুঃস্বপ্নের সেই দিনগুলোর কথা এভাবেই জানালেন তিনি।

কিন্তু দুশ্চিন্তায় পড়া রাজিবের সামনে আচমকাই সমাধান সূত্র হিসেবে এসে যায় পুরোনো একটি অভ্যাসের কথা। কি করা যায় চিন্তা করতে থাকলাম। মনে পড়ল, গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা থেকে খাঁটি সরিষার তেল এনে খেতাম। হঠাৎ ভাবলাম এই তেলই বিক্রি শুরু করব। ছোট ভাইয়ের মাধ্যমে নিয়েও আসলাম। ঈদুল ফিতরের দুই দিন আগে সেই তেল বিক্রি শুরু করেন পরিচিতজনদের কাছে।

এক সপ্তাহে ৫৫ লিটার তেল বিক্রি হলো। জুনে ৩০০ লিটার ও জুলাইয়ে ৪০০ লিটারের বেশি তেল বিক্রি হয়েছে। সঙ্গে মধুও বিক্রি শুরু করেছি। ১০ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে শুরু করছি, এখন ভালোই লাভ হচ্ছে, বলেন রাজিব।

এখন তো রীতিমত ব্যবসার পরিসর বাড়ানোর চিন্তাও করতে হচ্ছে তাকে। আর যে ব্যবসা তাকে জীবিকার পথ দেখিয়েছে, সেটা সততার সঙ্গে করে যেতে চান তিনি।

রাজিব বলেন, এখন মোটামুটি চলতে পারছি। তবে এতেই আমি সন্তুষ্ট না। আমি সবার কাছে খাঁটি সরিষার তেল পৌঁছে দিতে চাই। কারণ বাজারে যেসব তেল, ম্যাক্সিমামই ভেজাল। সেজন্য একটি কারখানা দিতে চাই।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও আর চাকরি খুঁজবেন না জানিয়ে তিনি বলেন, গার্মেন্টস সেক্টরে অনেক শ্রম দিতে হয়। সকাল ৬টায় বেরিয়ে রাত ১১টায়ও বাসায় ফিরতে পারতাম না। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এরপরও এখানে কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই ব্যবসাই করব।

আইএলওর জরিপে দেশে প্রতি ছয়জন তরুণের একজন বেকার হওয়ার যে তথ্য এসেছে, তার মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি।

মা-বাবা, ভাইকে নিয়ে মাহফুজা মৌয়ের তৈরি খাবার সরবরাহের ব্যবসা ভালোই চলছে। উদ্যোক্তা হতে পেরে তৃপ্ত তিনি। দেশে করোভাইরাসের কারণে চাকরি হারানো নারীদের একজন মাহফুজা মৌ। উত্তরার আলভি গ্রুপে গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কাজ করা এই তরুণীর জানুয়ারিতে কাবিন হলেও সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী মার্চে তার বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা বন্ধ হয়ে যায়। অনুষ্ঠান স্থগিতে আর্থিক ক্ষতিতে পড়া মৌয়ের জন্য এর চেয়েও বড় ধাক্কা আসে সাধারণ ছুটির প্রথম সপ্তাহেই।

মৌ বলেন, লকডাউনের পর অফিস সপ্তাহখানেক বাসা থেকে কাজের অনুমতি দিল। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই তারা জানিয়ে দিল আমি আর তাদের সঙ্গে কাজ করতে পারব না। জানাল তারা নিজেরাই কাজ পাচ্ছে না, আমাকে বেতন দেবে কীভাবে? মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আমার স্বামীও চাকরি হারাল। আমরা মহাবিপদে পড়লাম। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না।

অনেকদিন ধরেই একটা রেস্তোরাঁ করার ইচ্ছে ছিল মৌয়ের। মূলধনের অভাবে তা করতে না পারলেও করোনাভাইরাসের ধাক্কায় উদ্যোক্তা হওয়ার চ্যালেঞ্জটা নিলেন তিনি।

চাকরি হারিয়ে আমি আর আমার স্বামী যখন দিশেহারা, তখনই আম্মু পাশে দাঁড়াল, সাহস দিল। বললেন, এখন যেহেতু কেউ রেস্টুরেন্টে যাবে না, আমরা খাবার রান্না করে বিক্রি করতে পারি। ফেসবুকে একটা পেজ খুলতে বললেন আম্মু। কিন্তু আমি বললাম, অনলাইনে খাবার বিক্রি কঠিন হবে। এরপরও আম্মুর জোরাজুরিতে পেজ খুলে বসলাম।

৩০ জুন ‘আহার কেন্দ্র’ নামে একটি পেজ খুলে অনলাইনে খাবারের ব্যবসায় নামেন তিনি। বিরিয়ানি, পোলাও-রোস্ট, চিকেন গ্রিল ছাড়াও খুদের ভাত ও নানা পদের ভর্তা বিক্রি করেন মৌ।

পরিচিত এক আপু অসুস্থ থাকায় রান্না করতে পারছিলেন না। ৭ জুলাই তার কাছ থেকে প্রথম অর্ডার আসে। এভাবেই শুরু, এরপর থেকে অনেক ভালো সাড়া পেয়েছি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মৌয়ের চূড়ান্ত পরীক্ষা মার্চে হওয়ার কথা থাকলেও মহামারির কারণে তা আর হয়নি।

চাকরিতে আর ফিরবেন না জানিয়ে তিনি বলেন, আমি কারো অধীনে কখনই চাকরি করতে চাইনি। ব্যবসাকেই প্রেফার করতাম সবসময়। এখন সেটা শুরু করতে পেরে খুব ভালো লাগছে। আর চাকরি করব না। এই পেশাটাকেই বড় করার ইচ্ছা আছে। খুব ইচ্ছা একটা রেস্টুরেন্ট দেওয়ার।

মিরপুর ৬ নম্বরে বেড়ে ওঠা এই উদ্যোক্তা জানান, নতুন চ্যালেঞ্জে পুরো পরিবারের সহযোগিতা পাচ্ছেন তিনি। রান্নাটা মূলত আমার মা করেন। আমি গ্রিলটা খুব ভালো পারি। তাই গ্রিল ও বিভিন্ন ধরনের ভর্তা আমি করি। বাবা প্যাকেজিং করেন, ভাই ডেলিভারির কাজ করেন। আমি পেজ দেখাশোনা করি। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এ কাজে কোনো বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। কাজটা করে অনেক আত্মতৃপ্তি পাচ্ছি। করোনা আমাকে উদ্যোক্তা বানিয়ে দিল।

পোশাক কারখানায় কাজ করার অভিজ্ঞতাই কাজে লেগেছে আওরঙ্গজেব হিমেলের। ফেসবুকে তার ‘উইশ হাব’ নামের পেজটিতে তিনি পোশাকই বিক্রি করছেন। করোনাভাইরাসের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা অনেকেই কাজ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। শ্বাসকষ্ট ও অ্যাজমার সমস্যা নিয়ে বেড়ে ওঠা আওরঙ্গজেব হিমেল চাকরি করতেন নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায়।

লকডাউন শিথিলের পর এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে গার্মেন্ট চালুর কথা জানালে গলাব্যথায় ভুগতে থাকা হিমেল ঝুঁকি না নিয়ে অফিসে গিয়ে কর্তৃপক্ষকে অসুস্থতার কথা জানান। কর্তৃপক্ষ এক সপ্তাহ ছুটি দিলেও এরপর কাজে যোগ না দিলে চাকরি থাকবে না জানিয়ে দেয়। অসুস্থতা আরো বাড়লে চাকরিতে যোগ দেননি তিনি।

হিমেল বললেন, এরপর ভাবতে থাকি সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে চাকরি ছাড়া কীভাবে চলব? মনে হতে লাগল যে, ভুল করেছি। তারপর বোনের সহযোগিতা ও পরামর্শে অনলাইন ব্যবসার দিকে গেলাম।

‘উইশ হাব’ নামের একটি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে পোশাকের ব্যবসা করছেন এই উদ্যোক্তা। প্রথমে ৪ হাজার টাকার পণ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করেন হিমেল। আমি ২৪ মে ফেসবুকে একটা পেজ খুলি। গার্মেন্টসের প্রোডাক্ট যেহেতু আমি চিনি এবং এই সেক্টরে চেনাজানা আছে, তাই সেসব পণ্য বিক্রির চিন্তা করলাম। প্রথমেই বাচ্চাদের পোশাক দিয়ে শুরু করি। তারপর বেশ ভালো সাড়া পেয়ে ছেলে ও মেয়েদের পোশাকও আনা শুরু করলাম। ৮ জুন অনলাইনে প্রথম পণ্য বিক্রি করেন হিমেল। তিনি মনে করেন, চাকরি কিংবা ব্যবসা, যে কাজটাই করা হোক না কেন, তা করতে হবে মনোযোগ দিয়ে। তাহলেই সফল হওয়া সম্ভব।

"