এইচ আর তুহিন, যশোর

  ১৩ জুলাই, ২০২০

যশোরে ১.১৭ একর জমি দখলের পাঁয়তারা

যশোর সদরের মালিডাঙ্গা গ্রামে অন্যের ১ একর ১৭ শতক জমি দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে একটি জালিয়াতচক্র। ওই চক্রের হোতা মালিডাঙ্গার শম্ভুনাথ মল্লিকের দৌরাত্ম্য দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। রাজনৈতিক দুই নেতার নাম ভাঙিয়ে থানাকেও ‘ম্যানেজ’ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

শম্ভুনাথের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ ছাড়াও রয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট, সরকারি জমির ডিসিআর কেটে সেই জমি বিক্রির তথ্য। তিনি মানেন না ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের সালিস। তবে এসব বিষয়ে শম্ভুনাথ মল্লিক বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা। তিনি কারো জমি দখল করে রাখেননি।’

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শম্ভুনাথ মল্লিকের চোখ পড়েছে মালিডাঙ্গা কাজী মশিউর রহমানের ১ একর ১৭ শতাংশ জমির ওপর। দখলে নিতে চলছে নানা পরিকল্পনা। দেওয়া হচ্ছে হুমকি-ধামকি। আটকে দেওয়া হয়েছে চলাচলের পথ। অপর পথটি আটকাতেও নেওয়া হয়েছে ব্যবস্থা। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সরেজমিনে এসবের সত্যতাও মিলেছে। এদিকে এসব অভিযোগ পৌঁছালে খুলনা বিভাগীয় উপভূমি সংস্কার কমিশনারের কার্যালয়ে থেকে ‘আপোষনামার শর্ত বাস্তবায়ন ও অবৈধ দখল উচ্ছেদ প্রসঙ্গে’ যশোর জেলা প্রশাসক বরাবর একটি চিঠি আসলেও তার অগ্রগতি দেখা যায়নি। বিরোধের জমি সংক্রান্ত কাগজ থেকে জানা যায়, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কাজী মশিউর রহমান ২০ বছর আগে যশোর সদর উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নের মালিডাঙ্গায় ১ একর ৯১ শতাংশ জমি কিনে ভোগদখল করে আসছিলেন। নরেন্দ্রনাথ কর্মকারের ছেলেদের কাছ থেকে কেনা সেই জমির ৭৪ শতাংশ সরকারের খাস তালিকায় থাকায় ছেড়েও দেন তিনি। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে একটি মামলা চেয়ারম্যানের সালিসী সিদ্ধান্ত মোতাবেক তুলে নেন।

মশিউরের ছেলে কাজী নাঈমুর রহমান জানান, এরপর ফের শুরু হয় শম্ভুনাথ মল্লিকের নানা ফন্দিফিকির। ভুয়া ওয়ারিশনামা চেয়ারম্যান দফতর থেকে বাতিল হলেও তার বাবা কাজী মশিউরের জমি দখলে চলে পাঁয়তারা। তাকে দেওয়া হয় হুমকি-ধামকি। গত মার্চে কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ করেন তিনি। কিন্তু তা আমলে না নিলেও শম্ভুনাথের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মে মাসের মাঝামাঝি নরেন্দ্রপুর পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই গোলাম মর্তুজা তাদের শান্তি বজায় রেখে নিজ নিজ জমিতে অবস্থান করাসহ আদালতের আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে একটি নোটিস দেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, সেই নোটিসকেও তোয়াক্কা না করে কাজী মশিউরের জমি কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে নেন শম্ভুনাথ। এলাকাবাসী জানান, এ সময় বাধা দিতে গেলে কাজী নাঈমুর, তার ঘেরের কর্মচারীদের ওপর দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চড়াও হয় শম্ভুনাথ, তার ছেলেসহ সন্ত্রাসীরা। পরে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন নাঈমুর। ওই ডায়েরি প্রসঙ্গে তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের এসআই হারুনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অভিযোগের সত্যতা ছিল। জমির মালিকের ছেলে কাজী নাঈমুর রহমানকে মারধর করা হয়’। তদন্তকারী এই কর্মকর্তা প্রতিবেদকের এক প্রশ্নে বলেন, ‘আমি ঘটনার সত্যতা পেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর উচ্চতর তদন্তের জন্য আবেদন করি। তিনি মঞ্জুরও করেন। কিন্তু এরপর আমার বদলি হওয়ায় পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে বলতে পারছি না।’

ওই এলাকার বিধবা মমতা সরকারের ভাই শ্যামাপদ বকসি বলেন, ‘গোপাল চন্দ্র মল্লিকের ছেলে শম্ভুনাথ মল্লিক সবসময়ই ওই এলাকায় অশান্তি সৃষ্টি করে চলেছেন। তিনি জেলার দুই নেতার নাম ভাঙিয়ে নানা অপরাধ করে বেড়াচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে থানাও মামলা নিতে চায় না। তার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ভয়ে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন আমার নিঃসন্তান বিধবা বোন মমতা।’

ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা সরওয়ার হোসেন, স্থানীয় বাসিন্দা হাসমতসহ কয়েকজন জানান, ‘শম্ভুনাথ মল্লিকের কার্যক্রমে আমরাও হতাশ। তার নামে কোনো অভিযোগ গেলে ইউপি সদস্য, চেয়ারম্যানরা সালিস করলেও মানেন না তিনি। সবার সামনে মেনে আসলেও কয়েক দিনের মধ্যে তা অমান্য করেন। এদিকে কিছু বলতে গেলে তার ছেলে বিপুল মল্লিক গুন্ডামি করে। সংখ্যালঘুদের প্রতি অত্যাচার ও নারী নির্যাতন মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখান।’

কয়েকটি ঘটনায় আইনের কাছে গিয়েও বিচার পাননি বলে অভিযোগকারী কাজী নাঈমুরের দাবি। গাছ কাটার পর হুমকি-ধামকি প্রসঙ্গে জানতে ওই ঘটনায় তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই ফকির ফেরদৌসের সঙ্গে গত কয়েক দিন মুঠোফোনে বার বার চেষ্টার পরও পাওয়া যায়নি। পরে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি প্রতি উত্তর করেননি।

অন্যদিকে এসআই গোলাম মর্তুজা বলেন, ‘জমিজমার বিরোধ দেখা আমার কাজ নয়। এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার্থে যা করার আমি করেছি। বাকিটা তাদের আদালতের মাধ্যমে সুরাহা করে আসতে বলেছি।’ জমির কাগজপত্র থাকার পরও মালিকপক্ষ কেন জমিতে যেতে পারছেন না, এমন প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই।

এদিকে শম্ভুনাথকে ওয়ারিশনামা দেওয়া ও পরে বাজেয়াপ্ত করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কচুয়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান বলেন, ‘ওয়ারিশনামার জন্য শম্ভুনাথ জানায় সে নরেন্দ্রনাথের ভাগ্নে। ওই এলাকার দুজনের কাছে একই কথা জানতে পারি। শম্ভুনাথের পক্ষে ওয়ারিশনামা দেওয়ার পর অভিযোগ এলে জানতে পারি সে আপন ভাগ্নে না। শম্ভুনাথও তখন জানায়, সে চাচাতো ভাগ্নে।’

অন্যদিকে জমির আপোষনামার পরও বার বার আক্রমণ হুমকি-ধামকি প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান বলেন, ‘এলাকায় শান্তি নিশ্চিতে আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব করেছি। অনেক দিনের বিরোধ হওয়ায় চার গ্রামের লোককে নিয়ে বোর্ড গঠন করে দুই পক্ষের সহমতে আপোষ মীমাংসা করে দেওয়া হয়েছে। এরপর একই বিষয়ে বার বার অভিযোগ আসতে থাকায় তাদের দুজনকেই আইন ও প্রশাসনের মাধ্যমে সমাধানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি আপোষনামার শর্তের পক্ষেই আছি, থাকব। প্রশাসনিক যাবতীয় কাজে আমার সহযোগিতা থাকবে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close