আন্তর্জাতিক ডেস্ক

  ০৫ জুন, ২০২০

বিবিসির প্রতিবেদন

লক্ষণ-উপসর্গ ছাড়াই করোনা ছড়ায়

মহামারি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানীরাও করোনাভাইরাসের একটি অদ্ভুত এবং উদ্বেগজনক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আরো প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন। আক্রান্ত অনেকের কাশি ও জ্বর হচ্ছে; তাদের স্বাদ এবং গন্ধ পাওয়ার ক্ষমতা চলে যাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হলো, এ ভাইরাসে আক্রান্ত কারো কারো আবার উপসর্গই দেখা দিচ্ছে না! তারা কখনোই বুঝতে পারছেন না যে তারা করোনাভাইরাস বহন করছেন এবং ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

গবেষকরা বলছেন, কতজন কোনো লক্ষণ ছাড়াই আক্রান্ত হচ্ছেন এবং ‘নীরবে ছড়িয়ে দেওয়া ব্যক্তিরা’ মহামারিটিকে বাড়িয়ে দিচ্ছেন কিনা তা বোঝা খুব জরুরি। প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ করে, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে। ১৯ জানুয়ারি সিঙ্গাপুরের একটি গির্জায় জড় হওয়া ব্যক্তিরা তখনো বুঝতে পারেনি ওই অনুষ্ঠান করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া নিয়ে গবেষণায় কত বড় প্রভাব ফেলবে। এটি ছিল সাধারণ একটি রোববার। ম্যান্ডারিন ভাষায় পরিচালিত হয়েছিল গির্জার ওই সার্ভিসটি। অনুষ্ঠানে এক দম্পতি অংশ নিয়েছিলেন, যাদের দুজনই ৫৬ বছর বয়সি এবং যারা সেদিন সকালেই চীন থেকে এসেছিলেন।

তারা যখন তাদের আসনে বসেছিলেন, তাদের পুরোপুরি সুস্থ বলে মনে হয়েছিল। তাই তারা ভাইরাসটি বহন করছেন এমনটি ভাবার কোনো কারণ ছিল না। সেই সময় অবিরাম কাশি কোভিড-১৯ এর সবচেয়ে বড় লক্ষণ হিসেবে দেখা হতো। আর মনে করা হতো এর মাধ্যমেই ভাইরাসটি ছড়ায়। তাই রোগের লক্ষণ না থাকার অর্থ এটি ছড়িয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

সার্ভিস শেষ হতেই দম্পতিটি চলে যান। তবে খুব শিগগিরই ঘটনা খারাপের দিকে মোড় নেয়। স্ত্রী ২২ জানুয়ারি অসুস্থ হতে শুরু করেন, তার দুই দিন পরে স্বামীও। তারা প্রাদুর্ভাবের কেন্দ্রস্থল উহান থেকে এসেছিলেন। তাই এটি অবাক হওয়ার কিছু ছিল না।

কিন্তু পরের সপ্তাহে, তিনজন স্থানীয় ব্যক্তিও সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেন। সিঙ্গাপুরের মহামারির প্রথম দিকের ধন্ধে ফেলা ঘটনাটি নিয়ে তদন্ত করতে দিয়ে বোঝা গেল, এই ভাইরাস কীভাবে এত সফলভাবে নতুন শিকার খুঁজে নেয়।

সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংক্রামক রোগের প্রধান ডা. ভার্নন লি বলেন, আমরা অত্যন্ত ধন্ধে ছিলাম। যে লোকেরা একে অপরকে চেনে না তারা কোনোভাবে একে অপরকে সংক্রমিত করেছে, তাও অসুস্থতার চিহ্ন না দেখিয়ে। তখন কোভিড-১৯ সম্পর্কে যা জানা ছিল তার সঙ্গে বিষয়টি খাপ খাচ্ছিল না। তাই ডা. লি এবং তার সহকর্মী বিজ্ঞানীরা পুলিশ কর্মকর্তা এবং রোগ খুঁজে পেতে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি তদন্ত শুরু করেন। কে কোথায় কখন ছিলেন তার বিশদ মানচিত্র তৈরি করেন। শুরু হয় কন্টাক্ট ট্রেসিং কীভাবে করা হয় তার সবচেয়ে ভালো নিদর্শন। এই প্রক্রিয়া দক্ষতার সঙ্গে এবং দ্রুতগতিতে চলায় বিশ্বের নজর পড়ে সিঙ্গাপুরের ওপর।

কয়েকদিনের মধ্যে তদন্তকারীরা চার্চের ১৯১ সদস্যের সঙ্গে কথা বলেন এবং জানতে পারেন যে তাদের মধ্যে ১৪২ জন রোববার ওই অনুষ্ঠানে ছিলেন। তারা দ্রুত পেয়ে যান সিঙ্গাপুরের স্থানীয়ভাবে আক্রান্ত তিন জনের মধ্যে মধ্যে দুজনই চীনা দম্পতির সঙ্গে একই অনুষ্ঠানে ছিলেন। তারা হয়তো গির্জার সাধারণ কার্যক্রম চলার সময় একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে পারে অথবা একে অপরকে শুভেচ্ছা জানাতে পারে।

এটি কীভাবে ভাইরাস ছড়িয়ে গেল তা ব্যাখ্যা করছে কেবল একটি মূল প্রশ্ন বাদ দিয়ে। প্রশ্নটি হলো, রোগ হওয়ার লক্ষণ না দেখানোর পরও কীভাবে দুই চীনা ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিল। এর ওপরে ছিল আরো বড় ধাঁধা। সংক্রমিত তৃতীয় জন ৫২ বছর বয়সি মহিলা তো ওই অনুষ্ঠানেই ছিলেন না। তিনি সেদিনই পরে একই গির্জার অন্য একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি কীভাবে সংক্রমিত হলেন?

অপ্রত্যাশিত প্রমাণ : তদন্তকারীরা গির্জার সিসিটিভি রেকর্ডিং ঘাটতে গিয়ে অপ্রত্যাশিত একটি বিষয় খুঁজে পেলেন। ওই মহিলা কয়েক ঘণ্টা পর যে আসনে বসেছিলেন, চীনা দম্পতিরা সেই আসনেই বসেছিলেন। যেভাবেই হোক, লক্ষণ না থাকা এবং অসুস্থ বোধ না করা সত্ত্বেও, চীনা স্বামী-স্ত্রী ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। হয়তো তাদের হাতে ভাইরাস ছিল আর তারা আসন স্পর্শ করেছিলেন। হয়তো নিশ্বাসের মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়িয়ে কোনো পৃষ্ঠতলের ওপর পড়েছিল।

ডা. লির জন্য, সবকিছু একসঙ্গে গাঁথার কেবল একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা ছিল ভাইরাসটি কারো শরীরে থাকলে তিনি লক্ষণ টের না পেলেও তা ছড়াতে পারেন। এটি এমন একটি উদঘাটন ছিল যা বিশ্বজুড়ে পরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কারণ তখন করোনাভাইরাস সম্পর্কে জনস্বাস্থ্য বিভাগগুলোর মূল বার্তা ছিল, সবসময় নিজের এবং অন্যের লক্ষণগুলোর দিকে নজর রাখা।

নীরবে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি : চীনের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, অ্যাসিম্পটমেটিক কেসের সংখ্যা লক্ষণ আছে এমন রোগীর সংখ্যার চেয়ে বেশি। বিজ্ঞানীরা লিখেছেন, রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসাবে নিঃশব্দ স্প্রেডার হিসেবে অ্যাসিম্পটমেটিক ক্যারিয়ারদের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করার জন্য, নরউইচের বিজ্ঞানীরা পুরো শহরের জনগণকে পরীক্ষা করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। এই উদ্যোগের নেতৃত্ব দেওয়া জীব বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র আর্লহ্যাম ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নীল হলের মতে, অ্যাসিম্পটমেটিক কেসগুলো হয়তো মহামারিটির ‘ডার্ক ম্যাটার’। তার শঙ্কা, অ্যাসিম্পটমেটিক কেসগুলোই হয়তো মহামারির বিস্তার ঘটাচ্ছে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় অনেক ব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও তা বন্ধ হচ্ছে না। যদি এমন লোক থাকে যারা জানেন না যে তারা গণপরিবহন ও স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা ব্যবহারের সময় আক্রান্ত থাকছেন, অবধারিতভাবে এটি সংক্রমণ বাড়িয়ে তুলবে। তার মতে লক্ষণ নিয়ে আসা রোগীদের ওপর ভিত্তি করে কোনো ব্যবস্থা নিলে শুধু সমস্যার অর্ধেকটা নিয়ে কাজ করা হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close