নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৪ এপ্রিল, ২০২০

‘সাধারণ’ মাস্ক ছাড়া কিছুই নেই চালকদের

করোনা প্রতিরোধে ‘সাধারণ’ মাস্ক ছাড়া কিছুই নেই চালকদের বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশেও বিভিন্ন সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ঢাকাসহ দেশজুড়ে নেওয়া এই সতর্কতামূলক কর্মসূচির আওতায় এরই মধ্যে সব ধরনের গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ ছুটি ঘোষণা করে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে এর কর্মীদের ঘরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে ঘরে থাকলেও যেহেতু খাবার লাগছেই তাই এর মধ্যেও চলছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যবাহী পরিবহন অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের ভ্যান, কাভার্ডভ্যান ও ট্রাক। এছাড়াও ওষুধ, জরুরি সেবা, জ্বালানি, পচনশীল পণ্য পরিবহন কাজে নিয়োজিত বাহনও এ নিষেধাজ্ঞার বাইরে রয়েছে। পথে দেখা মিলছে, চলছে রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, হিউম্যান হলার, লেগুনা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার মতো কিছু পরিবহনও।

ঝুঁকির মধ্যেও এ ধরনের পরিবহনগুলোর চালকরা সড়কে বের হচ্ছেন। এই জনসেবা কারো চাকরি, কারো পেটের তাগিদে। তবে ঝুঁকি নিয়ে পথে বের হলেও সরকারের নানা ঘোষণা ও সতর্কবাণী সত্ত্বেও প্রাণঘাতী ভাইরাসটি থেকে রক্ষা পেতে তাদের সঙ্গে নেই তেমন কোনো সুরক্ষা সরঞ্জাম। অনেকের কাছেই সাধারণ মানের একটি করে মাস্ক দেখা গেলেও সেটিও সবার কাছে নেই। আর যাদের কাছে আছে তারা একটি মাস্ক পরছেন অনেকদিন ধরে। কেউ কেউ কিনতে ও বাকিরা বদল করতে পারছেন না সামর্থ্য না থাকায়। এমনকি হাত ধোয়ার সাবান বা স্যানিটাইজারও সঙ্গে থাকছে না তাদের। অন্য সুরক্ষা সরঞ্জামের কথা শুনলেও সামর্থ্যরে অভাবে কেউ কিনতে পারেননি, শহর ঘুরে চোখে পড়েনি কোনো চালকদের গায়ে। এই চালকদের দাবি, মালিক বা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা তারা পাচ্ছেন না।

গত কয়েক দিনে নগরীর ট্রাক টার্মিনালগুলো ঘুরে দেখা গেছে, করোনাভাইরাস বিষয়ে চালকদের মধ্যে কিছুটা সচেতনতা তৈরি হলেও তা অপ্রতুল। প্রত্যেক চালকের কাছে সাধারণ মানের শুধু একটি মাস্ক ছাড়া আর কোনো ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) নেই। তাও একটি মাস্ক দিয়েই তারা পার করে ফেলছেন কয়েক সপ্তাহ। যদিও চিকিৎসকরা বলছেন, একবারের বেশি দ্বিতীয়বার একই মাস্ক ব্যবহার করা উচিত নয়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক রুস্তম আলী খান বলেন, আমাদের চালকরা খুবই কষ্টে আছে। অনেকেই এরই মধ্যে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। যারা আছেন তাদের মধ্যে কিছুটা সচেতনতা এসেছে। তবে ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য তাদের কাছে সাধারণ মাস্ক ছাড়া আর কিছুই নেই। সেটাও বহু ব্যবহৃত। হাত ধোয়ার জন্য সাবান বা স্যানিটাইজারও নেই। তাদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে হয়। সবগুলো স্টপেজে ভালো কোনো ব্যবস্থা রাখা নেই। তবে জেলা বা বিভাগীয় শহরগুলোতে তারা কিছুটা সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছেন। অনেকেই তাদের জন্য নানা সুরক্ষা সরঞ্জাম এনে দিচ্ছেন। আমরা মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি, তারা যেন শ্রমিকদের যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্রাক শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আহাম্মদ হোসেন বলেন, আমাদের চালকদের করুন অবস্থা। সাধারণ মাস্ক ছাড়া তাদের কাছে বেশি কিছু নেই। সরকার থেকে আমরা কিছু পাইনি। তবে বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিরা ট্রাক থামিয়ে চালকদের মাস্ক ও হ্যান্ড গ্লাভস দিচ্ছেন। তাছাড়া কিছু সংখ্যক ট্রাক ছাড়া আর পরিবহন চলাচল করছে না। কারণ সব জায়গায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।

দুপুরে সাতরাস্তা ট্রাক টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে, সারিবদ্ধভাবে সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে আছে বহু ট্রাক-কাভার্ডভ্যান। কয়েকটি ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের চালকের আসনে কয়েকজন চালককে ঘুমাতে বা বিশ্রাম নিতে দেখা গেছে। এ সময় তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। এমন এক ট্রাকচালকের নাম ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, ট্রাক বন্ধ থাকলে পেটে খাবার জোটে না। তাই ভাড়ার আশায় বসে আছি। যদিও এই মুহূর্তে বাসা থেকে বের হওয়া উচিত নয়। এরপরেও বের হতে হচ্ছে।

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাইদুল ইসলাম নামে অপর এক ট্রাকচালক বলেন, ১০ দিন আগে একটি মাস্ক কিনেছি। সেটি দিয়ে এখনো চলি। আমাদের টার্মিনালে হাত ধোয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। বেসিন, সাবান নেই। পথে ঘাটে কত ঝুঁকি। কিন্তু কোনো সুরক্ষা আমরা পাই না। হরতাল অবরোধ থেকে শুরু করে সব সময়ই আমরা রাস্তায় থাকি। এই মহামারি করোনাতেও আমরা রাস্তায়। কিন্তু সরকার আমাদের জন্য একটুও ভাবে না।

অনেকের মাস্কও নেই। রাজধানীর মহাখালী, সাতরাস্তা, গাবতলী ট্রাকস্ট্যান্ডে ঘুরে দেখা গেছে চালকদের হাতধোয়ার জন্য বেসিন, পানি ও সাবানের কোনো ব্যবস্থা করেনি কোনো কর্তৃপক্ষ।

সকালে নগরীর কারওয়ান বাজারে কথা হয় একদল ভ্যানচালকের সঙ্গে। তাদের মুখ খালি। পরস্পর কথা বলছেন। পথে বের হয়েছেন, সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা আছে কিনা জানতে চাইলে তারা মাথা নেড়ে জানান, তাদের সঙ্গে নেই সাধারণ মাস্কও। এদের একজন আফজাল হোসেন। তিনি বলেন, কে আমাদের মাস্ক দেবে? কোথায় পাব? একটি ৩ টাকার মাস্কের দাম এখন ৩০ টাকা। শুধু মাস্ক কি আর করোনা দমাতে পারবে? আল্লাহর ওপর ভরসা করে আছি। যেদিন তিনি মাফ করবেন সেদিন আমরা রক্ষা পাব। খিলগাঁও রেলগেট এলাকায় কথা হয় রিকশাচালক শাহজাহান মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ৮০ টাকা দিয়ে একটি মাস্ক কিনেছি। প্রতিদিন ব্যবহার করি। কিন্তু একটি মাস্ক দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা উচিত নয় এমন প্রশ্নে তার জবাব, সেটা তো আমরা জানি না। সবাই এমন করে ব্যবহার করছে তাই আমিও করছি।

সরেজমিন চালকদের অধিকাংশের মুখে পুনঃব্যবহারযোগ্য কাপড়ের মাস্ক দেখা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব মাস করোনাভাইরাস প্রতিরোধে উপযোগী নয়। এগুলো ডাস্ট বা ধুলাবালু থেকে রক্ষার জন্য পরা হয়ে থাকে। এ জাতীয় মাস্ক করোনাভাইরাস বা অন্য ক্ষুদ্র জীবাণু থেকে সুরক্ষা দিতে পারে না। শুধু বাতাসের ধূলিকণা থেকে হয়তো রক্ষা করতে সক্ষম। তবে পুনঃব্যবহারযোগ্য কাপড়ের মাস্ক ঠিকমতো পরিষ্কার না করা হলে এটির মাধ্যমেও সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি থেকে যায়। যারা এ জাতীয় মাস্ক ব্যবহার করেন, তারা নিয়মিত ও ঠিকভাবে পরিষ্কার করে তারপর ব্যবহার করবেন।

জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, করোনা প্রতিরোধ করতে পারে এমন মাস্ক হচ্ছে এন-৯৫। কিন্তু এগুলো আমাদের বাজারে পর্যাপ্ত নেই। যেগুলো আছে সেগুলোও সঠিক এন-৯৫ নয়। তাই যেসব মাস্ক ধোয়া যায় সেগুলো শ্রমিক শ্রেণির মানুষের ব্যবহার করা উচিত। মেডিকেল বা সার্জিকাল মাস্ক এ শ্রেণির মানুষের ব্যবহার করা উচিত না। বাংলাদেশের যেসব মাস্ক পাওয়া যায় সেগুলোর বেশির ভাগই করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সক্ষম নয়। তাই সবার উচিত হবে হাঁচি-কাশির ব্যাপারে সতর্কতা থাকা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close