প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ৩১ মার্চ, ২০২০

স্যানিটাইজার না পেলে সাবানে করোনা নাশ

ভিডিও চ্যাট হচ্ছিল চার বন্ধুর সঙ্গে। পোস্টগ্র্যাজুয়েট বন্ধু সব। একজন বলল, ‘স্যানিটাইজার তো পাচ্ছি না, তাই নুন-জলে হাত ধুচ্ছি। নুন-জল দিয়ে নাক পরিষ্কার করছি।’ আর একজন তার এন-৯৫ মাস্ক গলায় নামিয়ে বলল, ‘আমি ধুচ্ছি জীবাণুনাশক লোশন দিয়ে।’ ‘কেন, সাবান কী দোষ করল?’ ‘আরে, বললাম না, স্যানিটাইজার পাচ্ছি না!’ আবার বললাম, ‘সাবানে ধুচ্ছিস না কেন?’ ‘কোন সাবানে ধোব? সাবানে কি কাজ হবে? তা ছাড়া গরিব মানুষের কথা ভাব? তারা অত দাম দিয়ে স্যানিটাইজার কী করে কিনবে! নুন-জলের তো অ্যান্টিসেপটিক গুণ আছে বা যদি কষ্ট করে একটা ডেটল কিনে নেয়?’ একজন আর এক কাঠি ওপরে, ‘আমি সাবানে হাত ধুয়ে তার পর স্যানিটাইজার দিয়ে ধুয়ে নিচ্ছি।’

ছোটবেলার বন্ধু সব। তাও রাগ হয়ে গেল। বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে এদেরই যদি এ অবস্থা হয়, আমআদমির তবে কী হাল! কেন সবাই ধরে নিচ্ছে সাবানের চেয়ে স্যানিটাইজার ভালো? কেনইবা এন-৯৫ মাস্ক কিনে তারপর তা গলায় ঝুলিয়ে রাখা? কেন ওষুধ খেয়ে রোগ ঠেকানোর চেষ্টায় প্রাণ চলে যাচ্ছে মানুষের? বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন, তা মানতে বাধা কোথায়? তবে কি বিজ্ঞানে ডিগ্রিধারী হয়েও বিজ্ঞানে বিশ্বাস নেই আমাদের? একজন বললও সে কথা, ‘ডাক্তারদের কথা ছাড়। ওরা আজ এই কথা বলেন, কাল বলেন অন্য কথা। এখন বলছেন, এই ভাইরাস বাতাসে ভেসে বেড়ায় না। কাল শুনব, বাতাসেই ভেসে বেড়ায়। ওদের এ কথা সে কথার মাঝে, আমাদের প্রাণটাই তো যাবে!’ বললাম, শেষ চেষ্টা করলাম। ‘শোন, ডাক্তার বা বিজ্ঞানীদের চেয়ে আমরা এই ব্যাপারটা বেশি বুঝি না কিন্তু। কাজেই আয়, আমরা সবাই তাদের কথা ভালো করে বোঝে, সেইমতো চলি। তা-ও যদি বিপদ আসে, সেটাও তো তারাই সামলাবেন। তাই না?’ বন্ধুরা রাজি হলো। তখন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামী ও বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ সুমিত সেনগুপ্ত, যা যা বলে চলেছেন, তা জানালাম।

সাবান, স্রেফ সাবান : যেকোনো সাবান ব্যবহার করা যায়, নামিদামি হওয়ার দরকার নেই, বেশ হাত ভরে ফেনা হলেই হলো। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যেভাবে সাতটি ধাপে রগড়ে রগড়ে ধুতে বলা হচ্ছে, সেটা খেয়াল রাখবেন। মনে না থাকলে হাতের নখ, নেলপলিশ, সব বিসর্জন দিয়ে, ৩০ সেকেন্ড ধরে একেবারে কচলে কচলে ধুয়ে নিন। সাবান জলের সঙ্গে মৃত ভাইরাসও, যদি থেকে থাকে, চলে যাবে নালা-নর্দমায়। কারণ, সাবানের অণু ভাইরাসের চর্বির আস্তরণকে এমন টানা টানবে যে, সে মারা যাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে।

হাত ধোয়ার পর, নাক-মুখ-চোখে যত পারেন হাত দিয়ে নিন। চুলকে নিন। তারপর আর একবার ধুয়ে নেবেন। তবে ঘরের কোনো আসবাব, হাতল, সুইচ, টিভি রিমোট, মোবাইল, ব্যাগ, জামাকাপড়, সবজি, বাসন বা যেকোনো কিছুতে হাত দিলে হাত না ধুয়ে মুখে-চোখে-নাকে লাগাবেন না। কারণ যদি অসাবধানে আপনার বা আপনার বাড়ির কারো হাঁচি-কাশি মারফত কয়েক ঘণ্টার জন্য এসব জায়গায় অস্থায়ী আবাস বানিয়ে থাকে ভাইরাস, হ্যাঁ অস্থায়ী আবাস, কারণ জীবিত কোষ ছাড়া কয়েক ঘণ্টার বেশি ভাইরাস বাঁচতে পারে না, সে আবার আপনার হাতে লাগবে। সে হাত নাক-চোখ-মুখে লাগা মানে, আবার তাকে শরীরে ঢোকার সুযোগ করে দেওয়া। কেন দেবেন সে সুযোগ?

যদি লেগে যায় এক-আধবার? ভুল করে এক-আধবার লেগে গেলে অত টেনশন করবেন না। ঘরে রোগী না থাকলে বা আপনি যদি ডাক্তার-নার্স না হন, হাসপাতালের ধারে-কাছে না যান বা বিরাট জনতার মাঝখানে ঘুরে না বেড়ান, এক-আধবারে কিছু হবে না। আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এটুকু সামলে নেবে। টেনশন করলে বরং প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়লেও বাড়তে পারে।

তবে হ্যাঁ, ওই এক-আধবার যেন এক-আধবারেই সীমাবদ্ধ থাকে। ‘আমরা এত পলিউশন সামলে নিচ্ছি, কোভিড কী করবে,’ জাতীয় ভাবনা যদি মাথায় স্থান দিয়েছেন, বিপদ কেউ আটকাতে পারবে না। আমাদের প্রতিরক্ষা কাজ করবে ঠিকই, কিন্তু তার ভরসায় থেকে নিয়ম না মানলে বিপদের আশঙ্কা প্রতি পদে। আপনার একার নয়, আপনার হাত ধরে সবার। কাজেই জেগে থাকার সময়, প্রতি ঘণ্টায় নিয়ম করে সাবান জলে হাত ধুয়ে নিন, তাহলে আর কোথায় জীবাণু আছে, কোথায় হাত দিয়ে ফেললাম জাতীয় টেনশনে ভুগতে হবে না।

স্যানিটাইজার কী দোষ করল : একটাই দোষ, বেজায় দাম। লাগেও বেশি। ৩০ সেকেন্ড ধরে হাতের সামনে-পেছনে ঘষে ঘষে তাকে লাগাতে গেলে, কী পরিমাণে লাগবে বুঝতে পারছেন? পয়সা থাকলে ও ঘরে যদি মজুদ করে রেখে থাকেন ও তাতে যদি অ্যালকোহল ৭০ শতাংশের বেশি থাকে, ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু সাধারণ গরিব মানুষকে ভুল বোঝাবেন না। তাদের মাথায় ঢুকে যাচ্ছে যে স্যানিটাইজার না হলে প্রাণে বাঁচা যাবে না। ফলে খেয়ে না-খেয়ে তারা দোকানে লাইন লাগাচ্ছেন। না পেলে হতাশায় ভুগছেন। এর মধ্যে আবার অনেকে স্যানিটাইজার বানাতে শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু তাতে অ্যালকোহল কত আছে কেউ জানে না। অনেকে আবার স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুচ্ছেন। মানে স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ঘষে জল দিয়ে ধুয়ে নিচ্ছেন। ‘ভুল করছেন,’ জানালেন চিকিৎসক সুমিত সেনগুপ্ত। ‘অ্যালকোহল মেশানো রাব দিয়ে হাত ঘষে হাওয়ায় তা শুকিয়ে নিতে হয়। না হলে কাজ হয় না। তা ছাড়া, যেখানে জলের জোগান আছে, সেখানে সাবান ব্যবহার করাই সবচেয়ে ভালো। রাস্তাঘাটে সে সুযোগ না থাকলে তখনই কেবল স্যানিটাইজারের প্রশ্ন। তবে মনে রাখবেন, স্যানিটাইজার এমন পরিমাণে নিতে হবে যাতে ৩০ সেকেন্ড ধরে হাতের সামনে-পেছনে, আঙুল, সব ভালো করে ঘষে নেওয়া যায়। দুফোঁটা দিয়ে হাত একটু ঘষে নিলে কোনো কাজই হয় না।’ অতএব, বুঝতেই পারছেন, ধনী-দরিদ্র সবার জন্য সাবানই সবচেয়ে ভালো পন্থা। হাতের কাছে জল না থাকলে তখনই একমাত্র স্যানিটাইজার ব্যবহার করার প্রশ্ন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close