গাজী শাহনেওয়াজ

  ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

আইসিডির ডিপোচার্জ বাড়ানো নিয়ে দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব

চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে বেসরকারি আইসিডির (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) চার্জ বাড়ানো নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে পোশাক শিল্পের ব্যবসায়ী সংগঠনের শীর্ষ নেতারা। অপরদিকে, বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোটস অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা) বলেছে, বর্ধিত চার্জ দ্রুত কার্যকর না করা হলে সেবা প্রদান কার্যক্রম বন্ধ রাখবেন। দীর্ঘদিনেও চার্জ বৃদ্ধি ইস্যুতে কোনো সমঝোতা না হওয়ায় আইসিডি মালিক ও স্টেকহোল্ডাররা পরস্পরবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছেন। কারণ দফায় দফায় সভা করেও কোনো পক্ষই সমঝোতায় পৌঁছাতে পারছে না। এ নিয়ে চলতি বছরে তিনটি সভা হয়েছে। সর্বশেষ গত সোমবার ব্যবসায়ী সংগঠন ও বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোটস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) মধ্যকার সভাটিও নিষ্ফলভাবে শেষ হয়। এদিকে নৌ মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে এ প্রশ্নে দুই পক্ষ একটি সমঝোতায় না এলে এখনই এ ব্যাপারে কিছু করা সম্ভব না। সূত্রগুলো বলছে, চার্জ বৃদ্ধির বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে বিশেষ করে গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকসারিজ অ্যাসোসিয়শেন এবং বিজিএমইএ সংগঠনের নেতারা বেশি সোচ্চার। তারা বলছেন, করোনার কারণে পোশাক শিল্প খাতের ওপরে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। এ শিল্পের রফতানি কমেছে। বেড়েছে পোশাক শিল্পের কাঁচামালের দাম। এই অবস্থায় কনটেইনার ডিপো চার্জ বাড়ানো হলে ব্যবসায়ে চরম ধস নামবে। এরই মধ্যে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। অনেক ঝুঁকিতে রয়েছে। চার্জ যদি বাড়াতে হয় সেটা আগামী এপ্রিলের আগে নয় পরে বাড়াতে হবে তাও যৌক্তিক পর্যায়ে থাকতে হবে।

অপরদিকে, বিকডা নেতারা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ আমলে না নিয়ে তারা বলেছে, আমরা ঋণ করে ব্যবসায়ীদের সেবা দিচ্ছি। দীর্ঘদিন ধরেই কোনো চার্জ নির্ধারণ হয়নি। যদি অচিরেই চার্জ বৃদ্ধি না করা হয় তাহলে আমাদের সেবা কার্যক্রম বন্ধ করে দেব। এমনকি দ্রুত সময়ের মধ্যে আরেকটি সভা করে চার্জ কার্যকর করার জন্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছে এ কর্তৃপক্ষ।

এদিকে, ব্যবসায়ী ও বিকডা দুই পক্ষের অনমনীয় আচরণে ক্ষুব্ধ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, সভায় দুই পক্ষের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য ও একজন অন্যজনের প্রতিপক্ষ মনে করে যে হইচই ও হট্টগোল করে তাতে সভায় সিদ্ধান্ত প্রদান করা দূরহ। কারণ ব্যবসায়ীরা বলছে, এ শিল্পের অবস্থা ভালো নয়। বিশেষ করে বিজিএমইএ এর সভাপতি রুবানা হক এই মুহূর্তে চার্জ বৃদ্ধির বিষয়ে আপত্তি তুলে বলেছে, আগামী এপ্রিলে তাদের বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে এই শিল্পের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরবেন তিনি। সেখানে ব্যবসায়ীদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে চার্জ বৃদ্ধি না বিদ্যমান অবস্থা অব্যাহত থাকবে সেজন্য আমাদের (মন্ত্রণালয়) অপেক্ষা করতে অনুরোধ জানিয়েছেন।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দরের আশপাশে ১৯টি বেসরকারি আইসিডি রয়েছে। বন্দরের ওপর চাপ কমাতে বেসরকারি পর্যায়ে এসব আইসিডি প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। বন্দর ইয়ার্ডের মতোই এসব প্রতিষ্ঠানে কনটেইনার স্টাফিং-আনস্টাফিং করা হয়। এছাড়া কনটেইনার জাহাজীকরণ এবং ডেলিভারিও আইসিডি কর্তৃপক্ষ করে থাকে।

এদিকে, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে চট্টগ্রাম আইসিডির ডিপোচার্জ বিদ্যমান ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত হয়। বর্ধিত চার্জটি ২০১৯ সালের ১ অক্টোবর থেকে কার্যকর করার সিদ্ধান্ত ছিল। সেই অনুযায়ী এটা কার্যকর করার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। এমনকি প্রতি বছর ডিপোচার্জ মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় ৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধির নির্দেশনাও ছিল। কিন্তু গত পাঁচ মাসে বর্ধিত ৫ শতাংশ কার্যকর করতে পারেনি মন্ত্রণালয় ও চবক কর্তৃপক্ষ। এর আগে বিদায়ী বছরের ১ আগস্ট থেকে ২৫ শতাংশ এক তরফা চার্জ বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছিল আইসিডি মালিকদের সংগঠন বিকডা। এর আগেও তারা কয়েক দফায় চার্জ বাড়ানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু প্রতিবারই বন্দর ব্যবহারকারীদের বিরোধিতার মুখে ব্যর্থ হয়।

বিকডার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে যে পরিমাণ পণ্য রফতানি হয়, তার ৯০ শতাংশ এবং আমদানি পণ্যের ২১ শতাংশ হ্যান্ডলিং হয় এ ১৯টি আইসিডির মাধ্যমে। আইসিডিগুলো প্রতি বছর ৩ লাখ টিইইউএস আমদানি কনটেইনার, ৬ লাখ টিইইউএস রফতানি কনটেইনার এবং ৮ লাখ খালি কনটেইনার হ্যান্ডলিং করছে। প্রতি বছর স্টেকহোল্ডাররা এ বাবদ আইসিডিগুলো প্রায় ৮৫০ কোটি টাকা চার্জ দিচ্ছে। ১০ শতাংশ হারে বাড়লে বছরে তাদের ৮৫ কোটি টাকা ব্যয় বাড়বে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি নৌ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুস সামাদের সভাপতিত্বে বিআইডব্লিউটিসির ফেয়ারলি হাউসে সংক্রান্ত সভা হয়। এর আগে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে ২০ জানুয়ারি আরেকটি সভা হয়। সভায় নৌ প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, আমদানি-রফতানিকারকদের ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা সরকারের দায়িত্ব। পাশাপাশি বিকডার লাভ-ক্ষতি বিবেচনা করাও দরকার। তিনি আরো বলেছিলেন, নিজ নিজ লাভ না দেখে দেশের স্বার্থে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু বিবেচনা করা উচিত। জবাবে ওই সভাতে উপস্থিত বিজিএমইএ’র সভাপতি রুবানা হক বলেছিলেন, গত ৬ মাস ধরেই পোশাক শিল্প খাতের অবস্থা খারাপ যাচ্ছে। এ সময়ে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ২৯.৬৪ শতাংশ। পরিস্থিতি এমন অবস্থায় গেছে সেখান থেকে উত্তরণ কঠিন। এরই মধ্যে ৬৯টি ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে এবং বড় ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণে নিমজ্জিত।

সর্বশেষ গত ২৪ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে সভা হলেও দুই পক্ষের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের কারণে ট্যারিফ বৃদ্ধির বিষয়ে কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, চার্জ বৃদ্ধি নিয়ে সভাতে দুই পক্ষই ব্যবসায়িক ক্ষতির কথা উচ্চৈঃস্বরে বলেন। বিশেষ করে পোশাক উৎপাদনকারী সংগঠন ও বিজিএমইএ বেশি সোচ্চার। তারা বলছে, বিভিন্ন দেশে করোনার প্রভাব এই শিল্পকে ভঙ্গুর অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে। এখনই চার্জ বাড়ালে পুরো সেক্টরে ধস নামবে। আর বিকডা সংগঠন বলছে, তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীদের সেবা দিচ্ছে। যদি দ্রুত সময়ের মধ্যে সভা করে চার্জ না বাড়ানো হয় তাহলে সেবা কার্যক্রম বন্ধের হুমকি দিয়েছে। আমরা (মন্ত্রণালয়) এক্ষেত্রে রেফারির ভূমিকা পালন করছি। দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা না হলে আমাদের এখানে করণীয় কিছু নেই। এদিকে, দীর্ঘদিনেও ত্রিপক্ষের (মন্ত্রণালয়, সেবাদানকারী সংগঠন বিকডা এবং ব্যবসায়িক সংগঠন) মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় ডিপোচার্জ নির্ধারণটি অনেকটা অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে হাঁটছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close