মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম, চট্টগ্রাম ব্যুরো

  ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

কর্মকর্তাদের আশ্বাস

এবার জলাবদ্ধতা থেকে রেহাই পাবে চট্টগ্রাম নগরবাসী

এবার চট্টগ্রামের নগরবাসীর দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ লাঘবের আশ্বাস দিয়েছেন কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, আসন্ন বর্ষায় চট্টগ্রামবাসী জলাবদ্ধতার কবল থেকে বহুলাংশে রেহাই পাবে। চট্টগ্রামের দুর্ভোগ মানেই জলাবদ্ধতা। সেই দুর্ভোগ নিরসনের জন্য ৫ হাজার ৬১৬ কেটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ের প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন শীর্ষক’ প্রকল্পের দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর প্রকল্প কর্মকর্তাসহ প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলছেন, এবার অতীতের মতো দুর্ভোগ আর হবে না। তিনস্তরে তদারকির কাজ চলছে। এই মেগা প্রকল্পটিকে স্থানীয় রাজনীতিবিদরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া চট্টগ্রামবাসীকে দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা লাঘবের উপহার। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।

চট্টগ্রামের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেড খালের উচ্ছেদ কার্যক্রম সফলতার সঙ্গে সমাপ্ত করেছেন। খালের আশপাশে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা তিন হাজারেরও বেশি অবৈধ স্থাপনা অপসারণের দূরূহ কাজ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে প্রকল্পটি দ্রুত সম্পন্ন করছে সেনাবাহিনী। এসব নানা স্থাপনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৮-তলা ইউএসটিসি ভবন থেকে শুরু করে প্রবর্তকের মোড়ে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসও রয়েছে। জানা গেছে, উঁচু ভবনটিসহ এসব ভবন তারা নিজেদের উদ্যোগেই ভেঙে ফেলতে শুরু করেছেন। ভরাট মাটি অপসারণ, রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ ইত্যাদি দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হচ্ছে সেনাবাহিনীর অংশের কাজগুলো। তবে এর সঙ্গে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) বাকি ভূমি অধিগ্রহণ কাজটি সময়মতো সম্পন্ন করতে পারলে চট্টগ্রামবাসী আগামী বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার হাত থেকে অনেকটা রেহাই পাবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন সেনাবাহিনীর প্রকল্প কর্মকর্তা।

চট্টগ্রাম জলাবদ্ধতা মেগা প্রকল্পটির বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহ আলী প্রতিদিনের সংবাদকে বলেছেন, ‘সেনাবাহিনী এ প্রকল্পের কাজ হাতে নেওয়ার পর আমাদের আওতাভুক্ত কাজগুলো ধাপে ধাপে কাজগুলো এগোচ্ছে। খালগুলোর পাশে ভূমি অধিগ্রহণের কাজটি সিডিএ করছে। এই ভূমি অধিগ্রহণের কাজটির ওপর নির্ভর করছে প্রকল্পের সিংহভাগ কাজের অগ্রগতি। যত তাড়াতাড়ি ভূমি অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন হবে, ততই মঙ্গল। কারণ, অধিকাংশ খালের আশপাশেই মাটি খননের ক্রেন যন্ত্রপাতি নেওয়ার সামান্যতম উপায় নেই। যেমনÑ জামালখান খাল, বদর খাল, হিজড়া খাল অন্যতম। নাসির খালে কিছুটা এখন কাজ করতে পারছি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা অবৈধ সব স্থাপনার প্রায় ৯৯ ভাগ সরাতে সক্ষম হয়েছি। গত জুলাই থেকে শুরু হওয়া খালের ওপর থেকে উচ্ছেদ কার্যক্রমের আওতায় প্রথম ধাপে ৩৬টি খালকে চিহ্নিত করেছিলাম। সেগুলোর শতভাগ আমরা সম্পন্ন করতে পেরেছি। কাজের সমন্বয়ের জন্য চারটি গ্রুপে স্থানীয় কাউন্সিলরদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছি। তাদের সহযোগিতা পাচ্ছি। তবে স্থানীয় জনসাধারণের প্রতি অনুরোধ থাকবে প্রকল্পের কাজের আওতায় যেসব গ্যাস, বিদ্যুতের খুঁটি, পানির লাইন রয়েছে ইত্যাদি সরানোর কাজে তারা যাতে আরো আন্তরিক হন। তবেই প্রকল্প কাজটি দ্রুততম সময়ে শেষ করতে পারব ইনশাআল্লাহ।’

লে. কর্নেল শাহ আলী আরো বলেন, ‘আমরা নগরীর ২০টি স্থানের মধ্যে ১৬টিতে ছোট-বড় অসংখ্য নালা-খালের শাখা-প্রশাখার কাজ করছি। বর্ষা মৌসুমে নগরীতে পানি যাতে না জমে সেজন্য স্থানগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোকে বড় খালে যাতে পানি যেতে পারে সেভাবে কাজ করেছি। ৫টি সিল্ট ট্র্যাপের কাজ চলছে। বর্তমানে ৩০টি খালের রিটেইনিং ওয়ালের কাজ চলছে। খালের ওপর ১২ থেকে ২২ মিটার দীর্ঘ ৩৮টি সেতু ও কালভার্টের কাজও সমানভাবে চলছে। সেনাবাহিনীর দায়িত্বে নেওয়া ৫টি স্লুইসগেট রেগুলেটরের মধ্যে অন্তত ৪টি (টেকপাড়া, মরিয়মবিবি, কলাবাগিচা, ফিরিঙ্গিবাজার) আগামী বর্ষার আগেই শেষ হবে আশা করছি। বাকি রেগুলেটরটি মহেষখালের কাজও এগিয়ে চলছে। এ মৌসুমে প্রকল্প কাজের ৪০ শতাংশ সম্পন্ন হবে আশা করি।’

কাজের অগ্রগতি নিয়ে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘যেহেতু চট্টগ্রামবাসীর এটি দীর্ঘদিনের একটি সমস্যা। তাই যাতে ত্রুটি না থাকে, এজন্য আমরা সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে প্রকল্পটি সফলভাবে সমাপ্ত করার দিকে দৃষ্টি রাখছি। খালগুলোর আশপাশে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ‘কনসালট্যান্ট ফার্ম ‘সিইজিআইএস’-এর দেওয়া ডিজাইন, ড্রয়িং, ভূমির বিএস দাগ ঠিক রেখে পরিবেশের ছাড়পত্রের জন্য দেওয়া হয়েছে। আমাদের সিডিএর পক্ষ থেকে প্রকল্প পরিচালক আহমদ মাইনুদ্দিন সেগুলো করছেন। আর সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলী বিদ্যুতের খুঁটি অপসারণ, গ্যাসলাইন, পানির লাইনসহ এ কাজগুলো দেখাশোনা করছেন।’

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, বাকি সøুইসগেটের কাজগুলো যেমনÑ বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাতে দেওয়া ২৩টির কাজে এখনো হাত দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে সিডিএর হাতে নেওয়া ১২টি সøুইসগেট রেগুলেটরের কাজও চলছে ঢিলেঢালা। সময়মতো এ কাজগুলো শেষ করতে না পারলে প্রকল্পের বেঁধে দেওয়া নির্ধারিত সময়ে বিলম্বত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে নগরবাসীর ভোগান্তিও বাড়বে।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জহিরুল আলম দোভাষ চলমান এ জলাবদ্ধতা প্রকল্পটি সম্পর্কে প্রতিদিনের সংবাদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, চট্টগ্রামের জনগণকে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার নিদর্শনস্বরূপ হাতে নেওয়া এ প্রকল্পটি একটি বিশেষ প্রকল্প। সেনাবাহিনী সিডিএর তত্ত্বাবধানে এই মেগা প্রকল্পটির কাজ সাফল্যের সঙ্গে ধাপে ধাপে অগ্রসর হচ্ছে। আশা করি প্রকল্পটি চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতার ভোগান্তি থেকে এবার মুক্তি পাবেন।

সিডিএর প্রকল্প পরিচালক আহমদ মঈনুদ্দিন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আমরা এ প্রকল্প কাজে নিয়মনীতি মেনে এগোচ্ছি। ফরমালিটি মেইনটেইন করতে সময় লেগে যাচ্ছে। বর্তমানে যে খালগুলো অবিলম্বে সংস্কার করা দরকার, সে বিষয়টি মাথায় রেখে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৩টি খালকে চিহ্নিত করেছি। এগুলো হচ্ছে, চাকতাই খাল, মীর্জা খাল ও হিজড়া খাল। প্রকল্প প্রস্তাবিত ভূমি অধিগ্রহণের জন্য প্রাথমিক ধাপে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয়। সেজন্য এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবনা পরিবেশ অধিদফতরে পাঠিয়েছি মাসখানেক আগে। পরিবেশের ছাড়পত্র পাওয়া মাত্রই আমরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় এ নিয়ে অগ্রসর হব।

সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামবাসীর জলাবদ্ধতার এ দুর্ভোগের স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন শীর্ষক’ ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকার এই মেগা প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। পাঁচ হাজার কোটি টাকার এ মেগা প্রকল্পটিকে রাজনীতিবিদরা বর্তমান সরকার কর্তৃক চট্টগ্রামবাসীকে দেওয়া উপহার হিসেবে দেখছেন। সিডিএ সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকার একটি প্রকল্প ২০১৭ সালে একনেকে পাস হয়। সিডিএর তত্ত্বাবধানে সেনাবাহিনী মেগা এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের মেয়াদকাল ধরা হয় ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন। তবে বৃহৎ এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি বেঁধে দেওয়া সময় সম্পন্ন করা হয়তো সম্ভবপর হয়ে উঠবে না, সে ক্ষেত্রে সময়সীমা আরো বৃদ্ধি করা হবে বলেও প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close