শাকিল মাহমুদ বাচ্চু, উজিরপুর (বরিশাল)

  ১২ ডিসেম্বর, ২০১৯

মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলা-ই তার কাজ

যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেক

কয়েক বছর আগেও যে মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষা করে নিজের জীবন বাঁচানোর আকুতি করছেন, তার দুঃখের করুণ চিত্র সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছিল ‘উজিরপুরের মুক্তিযোদ্ধা খালেকের চিকিৎসা হবে ভিক্ষার টাকায়’ ওই সময় তাৎক্ষণিকভাবে এই মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহায়তা পেয়ে এখন সুস্থ। তিনি গ্রামে গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলে বেরান। নতুন প্রজন্মকে শোনায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীরগাথা।

সরকারি তহবিল থেকে তাকে আর্থিক সাহায্য করা হয়েছে। তিনি এখন স্বাবলম্বীও হয়েছেন। প্রতি মাসে তিনি ভাতাও পাচ্ছেন। রক্তে যার মিশে আছে দেশপ্রেম তিনি কখনো ঘরে বসে থাকতে পারেন না। সে কথাটি প্রমাণ করেছেন উজিরপুরের গুঠিয়ার বানকাঠি গ্রামের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা খালেক হাওলাদার। বরিশালের উজিরপুর উপজেলার বুকচিরে বহমান সন্ধ্যা নদী। নদীর তীরে উজিরপুরের কমলপুর এলাকায় কমলাপুর-দাসেরহাট খেয়াঘাট। এ খেয়াঘাট দিয়ে প্রতিদিন কয়েক হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু যাতায়াত করে থাকে। তিনি এ খেয়া ঘাটে প্রতিদিন যাতায়াতকারী মানুষকে জড়ো করে ’৭১-এর স্মৃতিচারণ ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনান। উপজেলার বানকাঠি গ্রামের মৃত এন্তাজ উদ্দিন হাওলারের ছেলে ’৭১-এর রণাঙ্গনের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেক হাওলাদার (৯৬)। সাধারণ মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানানো ও নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশেই গত কয়েক বছর ধরে প্রতিনিয়ত এ কাজটি করে থাকেন তিনি। সন্ধ্যা নদীর উত্তর পাশে নদীর তীরে দেখা যায়, এক বৃদ্ধ মাটিতে বসে আছেন। তিনি একাকি মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতে শুরু করেন। মুহূর্তেই সেখানে শ্রোতা হিসেবে অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু জড়ো হন। খেয়ার জন্য অপেক্ষমাণ সবাই মনোযোগ সহকারে এ বৃদ্ধের কথা শোনেন।

কমলাপুর গ্রামের আবদুল হক জানান, উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়া বানকাঠি গ্রামের আবদুল খালেক হাওলাদার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। তিনি কোনো ভিক্ষুক নন। খালেক প্রতিদিন সকালে একাই এখানে এসে বসেন এবং সন্ধ্যা অবদি এখানেই বসেই খেয়াঘাটে অপেক্ষমাণ মানুষের কাছে তুলে ধরেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প। করেন মুক্তিযদ্ধের স্মৃতিচারণ। তরুণদের কাছে ’৭১-এর পাকিস্তানি হানাদারদের পৈশাচিক বর্বরতা তুলে ধরেন। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের কথা বলেন।

চা দোকানি আবদুল হক বলেন, মুক্তিযোদ্ধা খালেক খানজাহান আলীর ভক্ত। যদি কোনো পথচারী তাকে ভিক্ষা হিসেবে কোনো অর্থ দেন তা তিনি নেন না। যদি কেহ খান জাহান আলীর বার্ষিক উরস কিংবা মাজারের জন্য অর্থ দেন তাহলে নেন এবং গলায় ঝোলানো থলিতে জমা করে প্রতি মাসে বাগেরহাট গিয়ে ওই টাকা মাজার কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেন। এভাবে গত ১০ থেকে ১২ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রচার করছেন খালেক। মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেক হাওলাদার জানান, ১৯৭০-এর দশকের প্রথম দিকে তিনি ঢাকায় থাকতেন। পরবর্তী সময়ে বরিশালে ফিরে এসে আনসার সদস্য হিসেবে যোগদান করে বরিশালের আনসার ব্যারাকে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাসনে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সাহস ও উদ্দীপনা পান। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মে মাসে সেক্টর কমান্ডার উজিরপুরের মেজর এম এ জলিলের মাধ্যমে ৬০ জন সঙ্গী নিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান। সেখানে বিহার প্রদেশে তারা প্রশিক্ষণ শেষ করে ওই বছর আগস্ট মাসে খুলনা বর্ডার দিয়ে দেশে ঢোকার পরে মেজর জলিলের নির্দেশে খুলনার গোল্লাবাড়ি, বড়কুলিয়া, সাতক্ষীরা, যশোর, কালীগঞ্জ শ্যামনগরসহ বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধে অংশ নেন।

মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেক হাওলাদার বলেন, ’৭১-এর সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে গোল্লাবাড়ি পাকিস্তানি হানাদার ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা করি। সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমরা হানাদার ক্যাম্পের চারদিক থেকে গেরিলা হামলা চালাই। কয়েক ঘণ্টা গোলাগুলির পরে হানাদার ক্যাম্প থেকে পাল্টা জবাব আসা বন্ধ হয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনা সব মরে গেছে ভেবে আমি উঠে দাঁড়াতেই গুলি এসে আমার দুই পায়ে ও হাতে লাগে। সহযোদ্ধারা আমাকে নিয়ে চিকিৎসা দেন। পুরোপুরি সুস্থ্য না হলে দেশ স্বাধীনের পরে বঙ্গবন্ধুর সরকার আমাকে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করিয়ে আমাকে বাঁচিয়ে তুলেন।

গত ৪৮ বছর ধরে হাত পাবিহীন পঙ্গু জীবন নিয়ে দিন কাটাচ্ছি। পঙ্গুত্ব নিয়ে আমার কোনো কষ্ট নেই। কষ্ট হয় যখন দেখি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করছে একদল নতুন রাজাকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমান সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যেতে আমার পাস দরকার হতো না। বঙ্গবন্ধু বাড়ির সবাইকে বলে দিয়েছিলের খালেকের জন্য এ দরজা উন্মুক্ত। ’৭৫-এর আগস্টের শোকাবহ ঘটনার কথা উল্লেখ করে খালেক বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসির মধ্যদিয়ে জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। এটাই আমার পরম পাওয়া। থাকার জন্য সরকার ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে ঘর করে দিছে তাতে বসবাস করছি। ছেলেমেয়েকে বিয়ে দিয়েছি, মাসে ৫২ হাজার টাকা ভাতা পাই। খেয়ে দেয়ে ভালোই শান্তিতে আছি। যে কয় দিন বেঁেচ আছি এখন শুধু একটাই কাজ তা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানো ও নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা। খেয়াঘাটে বসে এ কাজটিই করে যাচ্ছি। উজিরপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মো. হারুন অর রশিদ বলেন, মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেক দুঃসাহসিক গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close