আলাউদ্দিন সোহাগ, পাইকগাছা (খুলনা)

  ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৯

বীরাঙ্গনার বাড়িতে মাদকের আখড়া

খুলনার পাইকগাছায় বীরাঙ্গনা গুরুদাসীর বাড়িটি অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বাড়িটি সংরক্ষণের অভাবে বখাটেরা তাদের আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করছে। বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধা কামান্ডের কাছে জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এলাকাবাসী। তারা আরো জানিয়েছেন, বাড়িটির প্রতি চোখ পড়েছে দখলদারদের। এছাড়া দিন-দুপুরেও এ বাড়িতে মাদকের আসর বসায় স্থানীয় ছিচকে মাস্তান ও নেশাখোররা। এই বাড়িটি তাদের নিরাপদ আখড়ায় পরিণত হয়েছে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী গুরুদাসীর ওপর নির্মম নির্য়াতন চালায় এবং তার চোখের সামনে স্বামী, ছেলে ও মেয়েকে হত্যা করে। স্বামী গুরুপদ মন্ডল ছিলেন পেশায় একজন দর্জি। স্বাধীনতাকামী অত্যন্ত সহজ সরল মানুষ ছিলেন তিনি, তার স্ত্রীর ওপর পাকিস্তানি দোসদের নির্মম অত্যাচারে বাধা দিলে তাকে এবং তার দুই ছেলে ও বড় মেয়েকে গুলি করে হত্যা করে তারা। গুরুদাসীর ছোট মেয়ে যখন মায়ের কোলে দুধ পান করছিল তখন পাকিস্তানি দোসরা ছিনিয়ে নিয়ে কাদামাটিতে পুঁতে হত্যা করে। গুরুদাসী অতি সুন্দরী হওয়ায় পাকিস্তানিরা তার নিজ বাড়িতেই আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা এ খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করেন। কিন্তু ততক্ষণে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নে স্বামী, ছেলে ও মেয়ে মিলে ছিল তাদের সুখের পরিবার। গুরুদাসী ছিলেন দুই ছেলে ও দুই মেয়ে সন্তানের জননী। পাকিস্তানি দোসরদের লালসার শিকার গুরুদাসীকে ওই সময় উদ্ধার করে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কাছেই রাখেন। দেশ স্বাধীন হলে মানসিক ভারসাম্যহীন গুরুদাসীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাবনার মেন্টাল হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেও সেখান থেকে চলে আসেন তিনি। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে অবশেষে পাইকগাছার কপিলমুনিতে আসেন। উপজেলা তথা দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে মানুষের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় মাসি। ভিক্ষাই ছিল তার জীবন জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন। সারা দিন বিভিন্ন জায়গায় লাঠি হাতে মানুষকে ভয় দেখানো, হাত পেতে দুই-এক টাকা চাওয়া এই মানুষটিকে মৃত্যুর আগে চিনতো না এমন মানুষ খুব কমই ছিল। শুধু উপজেলায় নয় দেশে বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ তাকে চিনত। কারণ তিনি এক দন্ড কোথাও বসতেন না। শুধু ছুটে বেড়াতেন বিভিন্ন অঞ্চলে। পাগল এই মানুষটি একটি কথা বেশি বলতেন, ‘কবে তার স্বামী, সন্তানদের হত্যাকারীদের বিচার হবে’?

তার নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট স ম বাবর আলী এবং নির্বাহী কর্মকর্তা মিহির কান্তি মজুমদার স্থানীয় কপিলমুনিতে সরকারি জায়গায় তার বসবাসের জন্য একটি বাড়ি তৈরি করে মাথা গোজার ঠাঁই করে দেন। বীরাঙ্গনা গুরুদাসী ২০০৮ সালের ৮ ডিসেম্বর এ বাড়িতেই মৃত্যুবরণ করেন। তার বসবাসের বাড়িটি এখন রাত-দিনে নেশাখোর ও অসামাজিক লোকদের আড্ডাস্থলে পরিণত হয়েছে। তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে গঠন করা হয়েছিল বীরাঙ্গনা গুরুদাসী স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ। ওই সময় নেতারা তার বসবাসের বাড়িটি স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার তৈরির ঘোষণা দেন। আজ অবধি তার কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। অযতেœ আর অবহেলায় পড়ে আছে গুরুদাসী মাসির স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি। স্থানীয় কয়েকজন জানান, একটি কুচক্রীমহল গুরুদাসীর বাড়িটি দখলের পাঁয়তারা চালাচ্ছে। বাড়িটি সংরক্ষণের ব্যাপারে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট স ম বাবর আলী বলেন, গুরুদাসীর বাড়িটি লাইব্রেরি করার পরিকল্পনা ছিল। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জুলিয়া সুকায়ানা বলেন, গুরুদাসীর স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর করার পরিকল্পনা রয়েছে। এদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করতে বীরাঙ্গনা গুরুদাসীর বাড়িটি সংরক্ষণ ও জাদুঘর করার দাবি জানিয়েছেন পাইকগাছাবাসী।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close