নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৩ নভেম্বর, ২০১৯

পূর্বাঞ্চল রেলের পথে পথে মরণফাঁদ

ব্রিটিশ আমলের নির্মিত লাইনে ভর করেই চলছে পূর্বাঞ্চলের রেলপথ। কখনো সেভাবে কোনো সংস্কার করা হয়নি। হয়তো দুর্ঘটনা ঘটলে কিছু সংস্কার করা হয়েছে। এখনো এ রুটের রেললাইনের অনেক জায়গায় স্লিপারের নাট-বল্টু নেই। যে কারণে সিলেটের রেলপথ যেন মরণফাঁদ হয়ে উঠছে। জরাজীর্ণ লাইনে ঘটছে ঘন ঘন ট্রেন লাইনচ্যুতের ঘটনা। এ কারণে নিরাপদ রেলসেবার মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে মানুষের মনে। যাত্রীদের মনে তৈরি হয়েছে সংশয়। তবে অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা এড়াতে ২০১৫ সালের জুলাই ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথ সংস্কারে পূর্বাঞ্চলে রেলক্রসিং পুনর্বাসন ও গেটকিপার নিয়োগে প্রকল্প হাতে নেয় রেল মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের মোট ব্যয় ছিল ৮০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। কিন্তু ধীরগতির কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেও শেষ হয়নি সে কাজ। তবে দুর্ঘটনা এড়াতে কর্মীদের দক্ষ করে তোলার পাশাপাশি সব লাইনে ডিজিটাল সিগন্যাল চালুর তাগিদ বিশেষজ্ঞদের। পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামছুল হক বলেন, কোনো না কোনো মানুষের ত্রুটির জন্য একের পর এক ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এখানে যান্ত্রিক কোনো ত্রুটি নেই বলে মনে হচ্ছে। না থামা জনিত কারণে এ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। বিশেষজ্ঞের মতে, ডিজিটাল সিগন্যাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে সব লাইনেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখে সেন্ট্রাল কমান্ড সেন্টার আবার চালু করা গেলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, চার বছর আগে এ প্রকল্পের আওতায় ৩২৮টি গুরুত্বপূর্ণ লেভেলক্রসিংয়ের পুনর্বাসন ও মানোন্নয়ন কাজ শুরু হয়। প্রকল্পটি ২০১৯ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিল। অথচ নির্ধারিত সময়ের পর আরো পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও কাজের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৬৯ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় এখনো ৩২৮টি রেলক্রসিং নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়নি। এর বাইরেও অননুমোদিত ও অরক্ষিত আছে এ অঞ্চলের ৮১১টি রেলক্রসিং।

বাংলাদেশ রেলওয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। অগ্রগতি ৬৯ শতাংশ। এ প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত অস্থায়ীভাবে ১৯০ জন গেটকিপার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর বাইরেও পূর্বাঞ্চলে আরো ৮১১টি অননুমোদিত, অর্থাৎ অবৈধ রেলক্রসিং রয়েছে। সেগুলোরও দ্রুত পুনর্বাসন জরুরি।

বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা হাবিবুল্লাহ বাহার বলেন, পূর্বাঞ্চলে ৩২৮টি রেলক্রসিং পুনর্বাসনের কাজ শেষ পর্যায়ে। আরো ৮১১টি অবৈধ রেলক্রসিং রয়েছে। আমরা বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় এগুলো পুনর্বাসনে কাজ করছি। নতুন কোনো প্রকল্প নেওয়া হলে তাতেই রেলক্রসিং পুনর্বাসনের কাজ অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।

জানা গেছে, ২০১৯ সালে দেশের রেলপথে সিলেট রুটে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, এত দুর্ঘটনা দেশের অন্য কোনো রুটে ঘটেনি।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, গত ৪ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী জালালাবাদ এক্সপ্রেস ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। এর আগে গত ১৭ সেপ্টেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টায় সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও রেলস্টেশনে জালালাবাদ ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। এর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে গত ৪ সেপ্টেম্বর ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মল্লিকপুরে এবং তারও আগে গত ১৬ আগস্ট ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও রেলস্টেশনে ঢাকাগামী আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন লাইনচ্যুত হয়।

গত ১৯ জুলাই সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া আন্তঃনগর জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেনটি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া জংশন রেলস্টেশনে ঢোকার সময় যাত্রীবাহী বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও যাত্রীদের কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। পরদিন (২০ জুলাই) সকাল ৮টা ৫৫ মিনিটে একইস্থানে গিয়ে ঢাকাগামী আন্তঃনগর কালনী এক্সপ্রেসের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়। ওইদিন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের লোকো সেকশনের এক কর্মচারী বলেছিলেন, আগের দিন দুর্ঘটনায় স্লিপারের অন্তত ২০টি ক্লিপ উঠে যায়। সেগুলো মেরামত না করায় পুনরায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে রেলের পাটাতনে ২-৩টি স্লিপারের পর একটি করে ক্লিপ লাগানো থাকে। যে কারণে ট্রেন দ্রুত চলতে গেলে লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটে।

এর আগে গত ২৩ জুন রাত ১০টায় সিলেট থেকে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন মৌলভীবাজারের কুলাউড়া স্টেশনে যাওয়ার আগে বরমচাল অতিক্রম করে মনছড়া রেলসেতুতে দুর্ঘটনায় ট্রেনের ৬টি বগি লাইনচ্যুত হয়। একটি বগি সেতুর নিচে ও দুটি পার্শ্ববর্তী জমিতে উল্টে যায়। এতে চার জন নিহত ও দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।

গত ১৬ মে বেলা ১১টার দিকে ফেঞ্চুগঞ্জ কুশিয়ারা সেতু পার হয়ে মল্লিকপুর এলাকায় লাইনচ্যুত হয় ট্রেনটি। এতে করে দেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

এর আগে ৫ এপ্রিল বেলা আড়াইটায় সিলেট-মাইজগাঁও রেলস্টেশনের মধ্যবর্তী মোগলাবাজার এলাকায় কুশিয়ায়া এক্সপ্রেস লোকাল ট্রেনটিতে ইঞ্জিন থেকে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এ অবস্থায় চালক ট্রেনটি টেনে মোগলাবাজার রেলওয়ে স্টেশনে নিয়ে যান। ট্রেনের ইঞ্জিন গরম হয়ে হঠাৎ করে আগুন লাগার ঘটনায় যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। এদিন রাত পৌ?নে ১১টার দি?কে মাইজগাঁও স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় শাহজালাল সারকারখানা থেকে সার বহনকারী বিসি স্পেশাল ট্রে?নের বগি?টি লাইনচ্যুত হওয়ায় ব্যাহত হয় যোগাযোগ ব্যবস্থা।

গত ৯ মার্চ ফেঞ্চুগঞ্জে অল্পের জন্য বেঁচে যায় জয়ন্তিকা ট্রেনের যাত্রীরা। ট্রেনটি ফেঞ্চুগঞ্জ কুশিয়ারা রেলসেতুর পাশেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায়। এদিন কুশিয়ারা রেলসেতুর দক্ষিণে রেললাইন ১ ফুট জায়গা ভেঙে যায়। এটা দেখে স্থানীয় ব্যবসায়ী ছালিক মিয়া তাৎক্ষণিক মাইজগাঁও স্টেশনে জানালে তারা ফোন করে দুই পাশের ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেন। তাৎক্ষণিক রেল যোগাযোগ বন্ধ করা না হলে ভয়ানক কিছু ঘটতে পারত।

সর্বশেষ গতকাল ভোররাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় ঢাকামুখী তূর্ণা নিশীথার সঙ্গে উদয়নের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ১৬ জন যাত্রী নিহত হন, আহত হন শতাধিক।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close