সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি

  ১৬ অক্টোবর, ২০১৯

সিরাজগঞ্জে মৃৎশিল্পে দুর্দিন, পেশা হারাচ্ছেন শিল্পীরা

একসময় সিরাজগঞ্জের গ্রাম এলাকায় মাটির তৈজসপত্র ছাড়া চলতই না। গ্রামে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, বদনা, কলস, বঁটি, থালা ও গ্লাস ব্যবহার করত। এমনকি মুরগির খোপ, পানি সুপারি রাখার পাত্র ও রান্নার চুলাও ছিল মাটির, মাটির তৈরি বসতভিটায় থাকতেন গ্রামীণ মানুষ। এখন দিন পাল্টেছে, এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মাটির তৈরি তৈজসপত্রের জায়গা দখল করে নিয়েছে অ্যালুমিনিয়াম, সিরামিকস আর কাচের পাত্র। অনেকে ব্যবহার করেন লোহা, মেলামাইন স্টিল ও প্লাস্টিকের তৈরি জিনিসপত্র। এতে বিনষ্ট হচ্ছে পরিবেশ, হারিয়ে যাচ্ছে কৃষি জীববৈচিত্র্য, সেইসঙ্গে গ্রামীণ সমাজের সেই চিরচেনা রূপ। আর বাপ-দাদার পুরোনো পেশায় থাকতে পারছে না মৃৎশিল্পীরা। আগের মতো আর কদর নেই মাটির তৈরি পণ্যের। ফলে তাদের জীবন থেকেও হারিয়ে গেছে সেই প্রাণচাঞ্চল্য। আর জীবনে নেমে এসেছে অভাব অনটন ও দরিদ্রতা। পুরোনো পেশা ছাড়ছেন তারা। দারিদ্র্যতার ছোবলে এই পেশার লোকেরা আজ ক্ষত-বিক্ষত।

আগের দিনে, প্রতিটি বাড়িতে থাকত পাতকুয়া। পাতকুয়া তৈরি হতো মাটির রিং দিয়ে। আর কার্তিক-অগ্রহায়ন মাসে নতুন ধান উঠত। ঘরে ঘরে শুরু হত নবান্ন। নাইয়র আসত জামাই ঝি। ঘরে ঘরে আনন্দের ঢেউ খেলে যেত। হরেক রকমের পিঠা এবং পাটালি গুড়ের পায়েসসহ নানা উপাদেয় খাবার তৈরি হতো। এসব খাদ্যসামগ্রী তৈরি এবং সংরক্ষণ করা হতো মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিলেই।

গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে মাথায় ঝাকা, আর কাঁধে ভাড় নিয়ে মাটির হাঁড়ি-পাতিল বিক্রি করত মৃৎশিল্পীরা। তাদের হাঁকডাকে ঘর থেকে বের হয়ে আসত বৌ-ঝিরা। দরকার অনুযায়ী এসব পণ্য কিনে নিতেন তারা। হাট-বাজারেও বেচাকেনা হতো। বেচাকেনাও ছিল ভালো। মৃৎশিল্পীরা সুখে শান্তিতে বসবাস করত। এখন সেসব অতীত দিনের স্মৃতি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে।

এরপরও তাড়াশ ও রায়গঞ্জ উপজেলায় অনেক বাড়িতেই এখনো দেখা যায় মাটির ঘর। আজও কেউ কেউ আঁকড়ে ধরে আছেন সেই পুরোনো দিনের প্রথা। গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অনেকে এখনো ব্যবহার করে চলেছেন মাটির তৈরি তৈজসপত্র। তাদের কারণেই ধিকি ধিকি বেঁচে আছে এই পেশার মানুষ।

এ ছাড়াও টিকে থাকার শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে অনেকে ঝুঁকেছেন হিন্দুদের ধর্মীয় পূজা পার্বনে প্রতিমা তৈরির কাজে। অনেকে ফুলদানি, ফুলের টব, মাটির টেরাকোটা, নানা ধরনের নকশা, মাটির তৈরি অলঙ্কার তৈরির কাজের দিকে মন দিচ্ছেন। পহেলা বৈশাখ, বিজয় দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসসহ নানা উৎসবে এর রয়েছে আলাদা কদর।

নিজেদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয় বলে প্রতিদিনের সংবাদকে জানায় মৃৎশিল্পী বদন পাল। তিনি বলেন, বছরের নির্দিষ্ট সময়ে আমরা প্রতিমা তৈরি করে থাকি। রংসহ অন্যান্য সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। এখনো জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে টয়লেট বা পায়খানায় ব্যবহারের জন্য মাটির পাট (রিং) তৈরি করে থাকি। তাতেও লাভ কম হয়। প্রভাত কুমার পাল বলেন, আজ বাজারে এসেছে কড়ি, মেলামাইন, লোহা, স্টিল, প্লাস্টিক সামগ্রী। সেসব সামগ্রীই কিনছে মানুষ। তবে দরিদ্র দিনমজুর পরিবারের অনেকে এখনো ব্যবহার করে চলেছেন মাটির তৈরি জিনিসপত্র। এ ব্যাপারে বয়োবৃদ্ধা খয়রন বেওয়া (৮০) প্রতিদিনের সংবাদকে জানান, আর কত দেখমু বাবা। মরার পরে তো মাটির তলেই যামু। যে কয়দিন বাইচা থাকি, মাইটা পাইল্যা (পাতিল) নড়া চাড়াই করমু। উল্লেখ্য, তার রান্নাঘরের সব পাত্র এখনো মাটির।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close