নিজস্ব প্রতিবেদক
সুন্দরবনে আশঙ্কাজনক হারে কমছে ডলফিন
অভয়ারণ্য বাড়ানোর প্রস্তাব
১৩ বছরের ব্যবধানে সুন্দরবনের নদীগুলোতে ডলফিন কমেছে উদ্বেগজনক হারে। এ অবস্থায় ডলফিনের সাতটি হুমকি নিরসনে বিভিন্ন কার্যক্রম চালাচ্ছে বন বিভাগ। এ ছাড়া বনের আরো প্রায় ৩৪ বর্গকিলোমিটার নদীতে ডলফিনের অভয়ারণ্য করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে বন বিভাগ। আর প্রকল্পের আওতায় বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে ১ হাজার জেলের।
সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থা ওয়াইল্ড লাইফ করজারভেশন সোসাইটির জরিপ অনুযায়ী ২০০৬ সালে সুন্দরবনের নদীগুলোতে ৪৫১টি ইরাবতি ও ২২৫টি শুশুক ডলফিন ছিল। তবে বন বিভাগের সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, বর্তমানে ইরাবতি ডলফিন আছে ১১৩টি আর শুশুক ডলফিন আছে ১১৮টি। আর বন বিভাগের সাম্প্রতিক জরিপের তথ্যানুযায়ী, সুন্দরবনে এখন ইরাবতী ডলফিন আছে ১১৩টি ও শুশুক ডলফিন ১১৮টি।
ডলফিন জরিপের সঙ্গে যুক্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান বলেন, ডলফিনের সংখ্যা আগে কত ছিল তা আমার জানা নেই। তবে জরিপ চালিয়ে যে প্রতিবেদন তৈরি করেছি, তাতে ১১৩টি ইরাবতী ও ১১৮টি শুশুক ডলফিনের কথা উল্লেখ রয়েছে। সারা দেশের নদীতেই দূষণসহ বিভিন্ন কারণে ডলফিনের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। সুন্দরবনের নদীও এর বাইরে নয়।
বন বিভাগ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুন্দরবন ও সংলগ্ন এলাকার নদ-নদীতে জেলেদের জালে আটকা পড়ে ডলফিন মারা যায়। বেশ কয়েকটি নদীতে ভারী নৌযান চলাচল করে। এসব নৌযানের প্রপেলার বা পাখার আঘাতেও ডলফিন মারা যায়। এ ছাড়া ডলফিন পাচার, অতিরিক্ত পরিমাণে মাছ আহরণ, মাছ ধরার ক্ষেত্রে নেট ও বেহুন্দি জালের ব্যবহার, পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি, বিষ দিয়ে মাছ ধরার কারণে ডলফিনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার শিল্প কারখানার বর্জ্যে পানিদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও ডলফিনের হুমকি বেড়েছে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ডলফিন রক্ষার জন্য ২০১৭ সালের জুলাই থেকে বন বিভাগের উদ্যোগে ‘গুরুত্বপূর্ণ জলজ প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনার জন্য রক্ষিত এলাকা সম্প্রসারণ’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়। ইউএনডিপির সহযোগিতায় এবং গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টাল ফ্যাসিলিটির অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বন বিভাগ। ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে আড়াই বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে আগামী ডিসেম্বরে।
প্রকল্পের আওতায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান এবং একই বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল আজিজ সুন্দরবনের নদীগুলোতে ডলফিনের ওপর একটি জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সেই জরিপ প্রতিবেদন শিগগির প্রকাশ করা হবে।
বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে সুন্দরবনের ঢাংমারী, চাঁদপাই ও দুধমুখী এলাকাকে ডলফিনের অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছিল বন মন্ত্রণালয়। এ তিনটি এলাকার ১০ দশমিক ৭ বর্গকিলোমিটার নদীতে ইরাবতী ও শুশুক ডলফিনের বিচরণ রয়েছে। জরিপ পরিচালনাকারী ওই দুজন শিক্ষক জানান, তিনটি অভয়ারণ্য এলাকার বাইরে সুন্দরবনের অনেক নদীতে এবং বন সংলগ্ন নদীর কয়েকটি এলাকায়ও ডলফিনের আধিক্য পাওয়া গেছে।
প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, এরই পূর্বে ঘোষিত তিনটি অভয়ারণ্য এলাকার বাইরে আরো কয়েকটি এলাকায় ডলফিনের আধিক্য পাওয়া গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে সুন্দরবনের মধ্যে ২২ বর্গকিলোমিটার এবং সংলগ্ন ১২ বর্গকিলোমিটার নদীতে ডলফিনের অভয়ারণ্য ঘোষণার জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এবং প্রকল্প পরিচালক মো. মদিনুল আহসান জানান, প্রকল্পের আওতায় ডলফিনের হুমকিগুলো নিরসনে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। যেসব এলাকায় ডলফিন রয়েছে সেখানে টহল জোরদার করা হয়েছে। ডলফিন এলাকাগুলোতে আগে যেসব জেলে মাছ ধরত সে রকম ১ হাজার জেলেকে বিকল্প জীবিকায়ন করা হয়েছে। বেসরকারি সংস্থা কোডেকের মাধ্যমে বিকল্প জীবিকায়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
তিনি জানান, প্রকল্পের আওতায় বিদ্যমান তিনটি অভয়ারণ্যের আটটি ফরেস্ট ক্যাম্পের আওতাধীন এলাকায় বনকর্মীরা জিপিএসের সাহায্যে ‘স্মার্ট পেট্রোলিং’ করছে। আইইউসিএন এবং সিএনআরএস নামে দুটি বেসরকারি সংস্থা বনকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও এলাকাবাসীকে সচেতন করার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। পুনর্বাসনের আওতায় আসা বেশ কয়েকজন সাবেক জেলে স্বেচ্ছাশ্রমে এখন ডলফিনের অভয়ারণ্য পাহারা দিচ্ছে।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচারের (আইইউসিএন) সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার এ বি এম সারওয়ার আলম দীপু জানান, প্রকল্পের আওতায় ডলফিনের বেশ কিছু হুমকি নিরসন করা সম্ভব হয়েছে। তবে এখনো কয়েকটি হুমকি রয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বনবিভাগের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে চলমান কার্যক্রমগুলো অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।
"