নওগাঁ প্রতিনিধি

  ২৩ আগস্ট, ২০১৯

সনদ থাকার পরও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম উঠেনি

নওগাঁয় তোফাজ্জল হোসেনের আক্ষেপ

সনদ থাকার পরও স্বাধীনতার ৪৮ বছর পেরিয়ে গেলেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি তোফাজ্জল হোসেন নামে এক মুক্তিযোদ্ধা। পারিবারিক দৈন্যদশায় তিনি স্বাধীনতার পর থেকে জীবিকা নির্বাহের জন্য বেছে নিয়েছেন প্রাইভেট পড়ানোকে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রশিক্ষণ সনদপত্র, প্রত্যয়নপত্র ও পরিচয়পত্র নিয়ে স্বীকৃতি পেতে আজও প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তিনি। মানবেতর জীবনযাপনকারী ৬৪ বছর বয়সি এ মুক্তিযোদ্ধার আকুতি, মরণের আগে যেন তিনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিটুকু দেখে যেতে পারেন। তিনি নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার চেরাগপুর ইউনিয়নের বয়ড়া গ্রামের মৃত আয়েজ উদ্দিন মন্ডলের ছেলে। এখন সপরিবারে নওগাঁ শহরের খাস-নওগাঁ মহল্লায় বসবাস করছেন। তার আর্থিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

জানা যায়, ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তোফাজ্জল হোসেন চতুর্থ। গ্রামের স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় অবশেষে আর পড়াশোনা চালিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। পরিবারকে সহযোগিতা করার জন্য বাবার সঙ্গে শ্রমিকের কাজ করতেন। প্রতিদিন সন্ধ্যার দিকে পাড়ার যুবকরা মিলে নিয়মিত রেডিও শুনতেন।

১৯৭১ সালে জানতে পারেন মুক্তিযুদ্ধকে জোরদার করতে লোক নেওয়া হচ্ছে। এলাকার অবস্থা বাবা-মা ও বড় ভাই পরামর্শ দেয় ভারতে যাওয়া জন্য। তখন ১৭ বছরের ওই যুবক পাড়ি জমান ভারতে। ভারতের ৭নং হিলি সেক্টর মধুপুর থেকে পতিরাম, পরে শিলিগুড়িতে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেন। সেখানে চার সপ্তাহের ট্রেনিংয়ে সংক্ষেপে যুদ্ধের কলাকৌশল শিখে নেন। তার ব্যাচে ছিল ৩০ জন যোদ্ধা। সেখানে ট্রেনিং অ্যাডজুটেন্ট ছিলেন, এস এইচ বারি এবং ক্যাম্প ইনচার্জ মহিউদ্দিন আহমেদ পরিচালনা করতেন প্রশিক্ষণ। ট্রেনিং শেষ করে মধুপুর থেকে কামারপাড়া যান অস্ত্র নেওয়ার জন্য।

যুদ্ধের জন্য এরপর চলে আসেন নওগাঁতে। সদর উপজেলার কৃর্ত্তিপুর-মাগুরা ও কুচগাড়ীর এলাকার মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান নেন নভেম্বর মাসে। তার গ্রুপে ১৭ জন যোদ্ধা ছিলেন। টিম লিডার ছিলেন আব্বাস আলী এবং ফিরোজ হোসেন। তারা দুজনেই মারা গেছেন। এলাকার লোকজন তাদের খাবার সরবরাহ করতেন। আর পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্প করেছিল জেলার বদলগাছী উপজেলার থানাতে। মুক্তিযোদ্ধারা যে এলাকায় অবস্থান নিয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা এই খবর পেয়ে যায়। তাদেরকে আটক করার জন্য নভেম্বর মাসের শেষের দিকে বদলগাছী থেকে নওগাঁর দিকে অভিযানে আসে পাকিস্তানি সেনারা। মুক্তিযোদ্ধারা বদলগাছী-নওগাঁ সড়কের শষীর মোড়ে মাটির রাস্তায় দুটি মাইন পুঁতে রেখে তা দূর থেকে দেখছিলেন। মেলেটারিদের গাড়ির চাকা মাইনের ওপর উঠামাত্র তা বিস্ফোরণ হয়। এতে ঘটনাস্থলে ছয়জন সেনা নিহত হন। আহত কয়েকজনকে পরে আরো সেনা এসে নিয়ে যায়।

দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৪ সালে নওগাঁ শহরে চলে আসেন তোফাজ্জল হোসেন। এরপর ১৯৮৭ সালে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন। শহরের খাস-নওগাঁতে বসবাস করছেন এখন। সেখানে প্রথম থেকে প্রঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাইভেট পড়ান। নাম দিয়েছেন ‘খাস-নওগাঁ প্রাইভেট হোম’। বছরের ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এই তিন মাস প্রাইভেট পড়ানো থাকে না। ফলে কষ্ট করে দিনাতিপাত করতে হয়। এক ছেলে আলফা আলামিন ইথার। পড়াশোনা শেষ করে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ১৯৭১ এর এই যুবক দেশকে শত্রুমুক্ত করতে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। সে কিনা আজ বড়ই অসহায়।

২০১০ সালে ১৯ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই তালিকায় তার সিরিয়াল ছিল ৪০৫ নম্বর। তার সঙ্গে সহযোদ্ধারা অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন। সরকারের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। অনেকে মারা গেছেন। মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে শুধু বাদ পড়েছেন তোফাজ্জল হোসেন। অথচ মুক্তিযোদ্ধার প্রমাণস্বরূপ প্রশিক্ষণ সনদপত্র, প্রত্যয়নপত্র ও পরিচয়পত্র থাকার পর মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হতে পারেননি।

মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল হোসেন অভিযোগের সুরে বলেন, গত ২০১৭ সালে ফেব্রুয়ারিতে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই বাছাই হয়। সেখানেও টাকার খেলা হয়েছে সেখানে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদেরও তালিকায় স্থান দেওয়া হয়েছে। আবার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা সব কাগজপত্র ঠিক থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন।

তিনি বলেন, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মরণের আগে যেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিটুকু দেখে যেতে পারি। এটাই প্রত্যাশা করছি জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নওগাঁ জেলা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার হারুন-অল-রশিদ বলেন, স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর হলেও আমরা স্বীকৃতি ও সম্মান পেয়েছি। এতদিন সেখান থেকেও তো বঞ্চিত ছিলাম। আগামী দিনে আমাদের সম্মান হয়তো আরো বাড়ানো হবে। যারা এখনো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে পারেননি তারা যেন তালিকাভুক্ত হন সে ব্যাপারে আমারা সহযোগিতা করব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close